নীলের ঘরে দিয়ে বাতি —

সোমদত্তা চ্যাটার্জীঃ

সদ্য গেল নীল ষষ্ঠী। এইদিন সন্তানের মঙ্গল কামনায় আমরা, মায়েরা মহাদেবের কাছে বাতি জ্বালি। আগে প্রদীপ দেওয়া হতো। এখন দিই মোমবাতি। প্রত্যেক সন্তানের জন্য এক-একটি বাতি বরাদ্দ। এবার মোমবাতি আনতে গেছিলেন কর্তা। মোমবাতির সংখ্যা তিন দেখে যারপরনাই বিস্মিত — সন্তানের সংখ্যা তো দুই, তবে মোমবাতি তিন কেন!?
মনে পড়ে গেলো দিব্যশ্রীর কথা। আমার ফেসবুকের বন্ধু দিল্লীর দিব্যশ্রী। ফেসবুকেই আলাপ। এমনিতে ফেসবুকের ভার্চুয়াল বন্ধুদের আমি বাস্তবের জগতে সাধারণত টেনে আনি না। তবে দিব্য ছিলো ব্যতিক্রম। দি’ভাই-দি’ভাই করে গেঁড়ে বসলো আমার রোজের জীবনে।
তখনো আনলিমিটেড কথা বলার সুযোগ চালু করেনি কোনো কোম্পানি। তাই সপ্তাহে একদিন করে টানা গল্প। বাকি দিনে মেসেজ চালাচালি। বেশ কাটছিল দিন। হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়লো দিব্য। শরীর ভীষণ দূর্বল। কথা বলতে গেলে হাঁফাচ্ছে। হাঁফাতে হাঁফাতেই বলল – শরীর টা বিশেষ ভালো নেই রে দি’ভাই। এবার আর নীল ষষ্ঠী করতে পারবো না। আমার ছেলেটার নামে একটা বাতি জ্বেলে দিবি তুই? এ আর কী কঠিন কাজ, নিশ্চই দেবো – আশ্বস্ত করলাম। দুজনেই ভেবেছিলাম পরের বার সুস্থ হয়ে দিব্য, নিজেই বাতি দিতে পারবে।
পরেরবার পরিস্থিতি আয়ত্বের বাইরে। হার মেনেছে দিল্লী AIMS-র এগারো সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড। তখনো ভিডিও কনফারেন্স এখনকার মতো জলভাত ছিল না। তবুও দিব্যর চিকিৎসার জন্য AIMS, সারা পৃথিবীর সেরা ডাক্তারদের নিয়ে করেছিল ভিডিও কনফারেন্স। কিন্তু দূরারোগ্য ঐ ফুসফুসের রোগের কোনো চিকিৎসা আমাদের দেশে তখনো সম্ভব ছিল না। মেডিক্যাল বোর্ড বেঁধে দিয়েছিল তিন থেকে ছ’মাসের সময়সীমা।
মৃত্যু কে বড় গ্রেসফুলি মেনে নিয়েছিলো মেয়েটা। কোনো রকম হাহুতাশ করেনি কো। এরকম টা সচরাচর দেখা যায় না। অন্তত, আমি কাউকে দেখিনি। তখনো দিব্য চল্লিশের কোঠা তেও ঢোকেনি। অথচ জয় করেছিল মৃত্যুভয়। আগে ওকে চাকরি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হতো। শেষ সময়ে চাকরি করার শারীরিক সামর্থ্য ছিল না। ছেড়ে দিয়ে ছিল। হাসত হাসতে বলতো – চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে বেশ ভালো হয়েছে বুঝলি। এতদিন ছেলে টাকে মোটে সময় দিতে পারি নি। এখন ওকেই সবচেয়ে বেশি দিই সময়। নাহলে বড় হয়ে ও তো আমাকে মনে করতেই পারবে না।
যেক’টা দিন ছিলো, স্বামী সন্তান কে নিয়ে চুটিয়ে যাপন করেছিলো জীবন। আর তাই বোধহয় মৃত্যু-ও গ্রেস দিয়েছিল সময়। ছ’মাসের সময়সীমা গড়িয়ে হলো ন’মাস। যাবার আগের নীল ষষ্ঠী তে আবার অনুরোধ – আমি মনে হয় না আর কখনোই বাতি দিতে পারবো রে, আমার ছেলের নামে বাতি জ্বালবি তুই?
সেই থেকে প্রতি বছর আমাদের ঠাকুর ঘরে জ্বলে তিনটে করে বাতি। বাতি প্রতিবার আমি নিজেই কিনে আনি। তাই অন্য কারো খেয়ালে পড়ে না। তবে এবার আমি-ও ধীরে ধীরে অশক্ত হয়ে পড়ছি। এবার আর নিজে আনতে যাইনি বাতি। তবে ‘মা’ যতদিন আমাকে নীলের ঘরে বাতি দেবার মতো সক্ষম রাখবেন, তিনটে করেই বাতিই দেবো। সঙ্গে থাকবে সেই চিরন্তন প্রার্থনা —
আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *