মনের মনিকোঠা ভেঙে

অনিতা মুখোপাধ্যায়

আমাদের অত্যন্ত দুর্ভাগ্য যে আমরা বীরভূমের এক পরম রত্নকে হারিয়ে ফেলেছি। এত তাড়াতাড়ি তাকে নিয়ে লিখতে হবে ভাবতে পারিনি। অথচ মানুষটি কোনোদিনই চাননি তাকে নিয়ে কিছু লিখি। কাঞ্চন দা কোনদিনই প্রচারের আলোয় আসতে চাননি। এমনকি মুখের সামনে প্রশংসা করাকে তিনি পছন্দ করতেন না। অথচ আশ্চর্যের বিষয় মানুষটি নিজেও কর্মগুণে প্রচারের আলোয় এসেগেলেন। কাঞ্চনদার অকাল প্রয়াণে আমরা শোকাহত ও মর্মাহত মৃত্যু নিয়ে মন যখন বিচ্ছিন্ন ও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে তখন সুন্দর একটি উপমা মনের মানসপটে ভেসে উঠলো। কর্ণ একবার শ্রীকৃষ্ণের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ভালো মানুষ আগে মারা যায় কেন? শ্রীকৃষ্ণ বললেন যখন তুমি ফুলের বাগানে ফুল তুলতে যাও তখন কোন ফুলটি আগে তোলো? কর্ণ বললেন, সুন্দর ফুলটি আগে তুলি। শ্রীকৃষ্ণ সহাস্যে বললেন তোমার প্রশ্নের উত্তর ওটাই। বীরভূমের গর্ব আদর্শ কাঞ্চনদা মানব সমাজের একটি সুন্দর ফুল তাই হয়তো ভগবান তাকে আগে তুলে নিলেন, তবে মহান মানুষের মৃত্যু হয় না। কাঞ্চনদারও মৃত্যু হয়নি। তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের মধ্যে। তার কাজের মধ্যে।অমর হতে গেলে অমৃত লাগে না। কর্মই যথেষ্ট। কাঞ্চনদার একটা হাত পাঁচ হাজার হাতের সমান। সেই পাঁচ হাজার হাত একত্রিত হয়ে আমরা কাঞ্চনদার একটা হাত হয়ে উঠবো। কাঞ্চন শূন্য বীরভূম, কাঞ্চনদা শূন্য আমরা একথা মন থেকে মানতে পারছি না। বিধাতার নিষ্ঠুর নিয়ম মাঝে মাঝে স্মরণ করাচ্ছে কাঞ্চন নেই। তখনই বিধাতার উপর রাগ হচ্ছে। কাঞ্চনদার উপর নীরব অভিমানে বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে। কাঞ্চনদা আপনি কোথাও হারেননি, কেন এত আগেই হেরে গেলেন? জঞ্জাল পূর্ণ সমাজে আর থাকতে চাইলেন না? তাহলে কে সরাবে এই জঞ্জাল? তেমন মানুষ যে দেখতে পাচ্ছি না কাঞ্চনদা।সমাজ যে আরও বিষময় হয়ে উঠবে। কে জোগাবে আমাদের ভরসা? কে দাঁড়াবে মাথার ছাতা হয়ে?
কাঞ্চনদা না কারোর অভাবে, না কারোর প্রভাবে, না কারোর স্বভাবে চলতেন। তিনি তাঁর স্বভাবে চলতেন।জীবনে সফল হতে গেলে জেদ আর আত্মবিশ্বাস দরকার যা কাঞ্চনদার মধ্যে প্রবলভাবে বিদ‍্যমান ছিল। কপর্দকহীন একটা মানুষ অসুস্থ শরীরে খেয়ে-না খেয়ে বীরভূম জেলার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত চষে বেড়িয়েছেন।
অসাধ‍্য সাধন করে দেখিয়েছেন।
তিনি বলতেন, সম্পর্কই সম্পদ।
আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলের সঙ্গে সাবলীলভাবে মেলামেশা করতেন।
তিনি জানতেন, রক্তের বন্ধনে শুধু সম্পর্ক তৈরি হয় না। সম্পর্ক তৈরি হয় অনুভূতির বন্ধনে। সেই অনুভূতির বন্ধন দিয়ে তিনি সম্পর্ক তৈরি করে গেছেন। তিনি ছিলেন এমন একটা মানুষ যার মধ্যে কোন গিঁট ছিল না। তাঁর বার্তা ছিল, জেলাকে চিনুন জেলাকে জানুন। কাঞ্চনদা অনেকের আশা ভরসা ও আশ্রয় প্রশ্রয় ও অভিভাবক হয়ে উঠেছিলেন তবে আমাদের মনুষ্য সমাজ বড় জটিল। যখন সত্যের সঙ্গে অসত্যের লড়াই হয়, তখন অসত্যের বাহিনী হয় বিশাল। তার পিছনে মূর্খ, লোভী, স্বার্থপর মানুষরা থাকে বেশী। তবুও সত্যকে দমাতে পারে না। কাঞ্চনদা ছিলেন সত‍্যের পূজারী। মানুষ অন্যের দোষ দেখতে পেলে বিচারপতি হয়ে যায়। আবার নিজের দোষ ঢাকার জন্য উকিল হয়ে যায়। কাঞ্চনদা এ দুটোর কোনোটিই ছিলেন না। অকপটে তিনি নিজের দোষ স্বীকার করতেন। কাঞ্চনদা বিতর্কিত হলেও বহু মানুষের প্রিয় ছিলেন। আজও অনেকের বুকে কান পাতলে শোনা যাবে একটা হাহাকারের শব্দ। কাঞ্চন সরকারকে হারানোর হাহাকার। সত‍্যের লজ্জা নাই, ভয় নাই, ভাবনা নাই। সে নিজেকেই প্রকাশ করে। তাই সত্য বেপরোয়া। কাঞ্চন সরকার ও ছিলেন বেপরোয়া। একমাত্র তিনিই দ্বিধাহীন মুক্তকণ্ঠে বলতে পারতেন, রাজা তোর কাপড় কোথায়? অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর কলম গর্জে উঠতো। এক্ষেত্রে তিনি মুখ বাছাবাছি করতেন না। উমেদারি, তাঁবেদারী, তোষামোদ এসব তাঁর ধাতে সইতো না। নিন্দুকের নিন্দা, সমালোচকের সমালোচনা, হিংসুটে ব্যক্তির হিংসা, শাসকের শাসানি সবকিছু অতিক্রম করে তিনি নির্ভয়ে পথ চলেছেন। তার চলার পথে কাঁটা বিছানোর লোকের অভাব ছিল না। সব বাধা-বিপত্তি, অবরোধ-প্রতিরোধ পায়ে দলে তিনি আমাদের সবার প্রিয় কাঞ্চনদা হয়ে উঠেছেন।
পনের বছর বয়সে কাঞ্চনদার বিয়ে হয়েছে এবং তিনি বহুবিবাহ করেছেন। ভাবছেন তো? আমি ভুল বলছি? না না ভুল ভাবছেন আপনারা। কাজের সঙ্গে যাঁর বিয়ে হয়, তাঁর আর অকাজের বিয়ের দরকার হয় না। তার এই বিয়েকে সম্মতি জানিয়েছেন তার পরিবারের লোকজন। তাঁর মা বলতেন, তুমি দশের হয়ে কাজ করো, এই আমার আশীর্বাদ রইল। ভাইয়ের শুকনো মুখ দেখতে না পেলে দিদিরা তাদের গয়নাগাটি সহ উপার্জিত অর্থ সব ভাইয়ের হাতে তুলে দিয়েছেন। এমনকি বসতবাড়িটাও ষোলো লাখ টাকায় বন্ধক রেখে তিনি তাঁরকাজ চালিয়ে গেছেন।কাঞ্চনদা মাঝে মাঝে দুঃখ করে বলতেন, অনিতাদি বাড়িটা ছাড়াতে না পারলে আমার দিদিরা পথে বসবে। তবুও তিনি ছাড়িয়ে যেতে পারেননি। অকাল মৃত্যু তাঁকে গ্রাস করল। দিদিরা এখন ঋণগ্রস্ত হয়ে আছেন। এ কথা হয়তো অনেকেই জানেন। আবার অনেকেই জানেন না।
আসলে কাঞ্চনদা একটা বই, যে বইটা আগাগোড়া অনেকেই পড়েছেন আবার অনেকেই পড়েন নাই।কাঞ্চন সরকার কে চিনতে গেলে তাকে পড়তে হবে।দূর থেকে কথা ছুড়ে দিয়ে যাঁরা তাঁকে কালিমালিপ্ত করেন তাঁরা বড় অভাগা। হয়তো তাঁদের দৃষ্টিশক্তি নাই অথবা ক্ষীণ। আবার হয়তো জেনে বুঝেও অন্ধ থাকার ভান করেন। ভগবান পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে তাঁদের এই নোংরামি করার, অন্ধ সেজে থাকার অভিনয় করতে পাঠিয়েছেন। এতে তাঁদের কোনো দোষ নাই।সব দোষ ভগবানের।
কাঞ্চনদা কখনো মানুষের দোষ ধরতেন না। তিনি মানুষের গুনের কদর করতে জানতেন। অসাধারণ হয়েও তিনি ছিলেন অতি সাধারণ। তিনি ছিলেন একটা সুস্বাদু ডাবের মত। উপরটা ছিল কঠোর, ভিতরটা ছিল নরম। গরীবের দুঃখ দেখলে তিনি কাতর হয়ে পড়তেন। কতবার পুজোর সময় তিনি গরীব দুঃখীদের মধ্যে পোশাক বিতরণ করেছেন।আমি নিজে তার সাক্ষী আছি। কাঞ্চনদাকে হারিয়ে আমাদের মনে শান্তি নেই, স্বস্তি নেই। আমরা যেন বড় নিঃস্ব হয়ে গেছি। তিনি নেই এটা যেন একটা চরম বিস্ময়। আর এই বিস্ময়ের ঘোর যেন কিছুতেই কাটছে না। আসুন বীরভূমবাসী, আসুন কাঞ্চন প্রেমিক মানুষজন আমরা কাঞ্চনদার পাশে থাকি, কাঞ্চনদার সাথে থাকি। তাঁর স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখি।আসুন আমরা শপথ করি, যতক্ষন দেহে থাকবে প্রাণ, ধরে রাখবো সবুজের অভিযান। যতক্ষন করতে পারবো কর্ম, বাঁচিয়ে রাখবো নয়াপ্রজন্ম।
কাঞ্চনদা কখনও নিজেকে, সমাজসেবক, সাংবাদিক, দক্ষসংগঠক, নয়াপ্রজন্ম, নবজাতক, সবুজের অভিযান ও বসুন্ধরা মঞ্চের স্রষ্টা বলতেন না। তিনি নিজেকে ভিক্ষাজীবী বলতেন। লোক দেখানো ভড়ং তিনি পছন্দ করতেন না। কাঞ্চনদার আত্মা শান্তি পাক বললে তাঁর আত্মা শান্তি পাবে না। স্মরণসভা করে মুখে বড় বড় কথা বললেও তাঁর আত্মা শান্তি পাবে না। কাঞ্চনদার আত্মা শান্তি পাবে তাঁর কাজকে সম্মান জানাতে পারলে। সমাজসেবা করতে করতে তিনি চলে গেলেন। কাঞ্চনদার প্রাণহীন দেহ এখনও সাঁইথিয়া বিবেকানন্দ হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজে নীরবে সমাজসেবা করে যাচ্ছে।
কাঞ্চনদা প্রচার পছন্দ করতেন না বলেই হয়তো কোনো মিডিয়া কাঞ্চনদার এতো বড় ত‍্যাগকে নিয়ে হইচই ফেলেন নাই। কাঞ্চনদার মতো ত‍্যাগী ভিক্ষাজীবী কে প্রণাম জানাই। প্রণাম কর্মবীর শতকোটি প্রণাম। ভগবানের কাছে প্রার্থনা বাংলার ঘরে ঘরে যেন কাঞ্চন সরকারের মত ছেলে জন্মায়।দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালনকর্তার অভাব মোচনের জন্য যে কাঞ্চন সরকারকে খুব দরকার।

One thought on “মনের মনিকোঠা ভেঙে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *