তীর্থ কুমার পৈতণ্ডী
২৮ জানুয়ারী দিনটা আমাদের কাছে যেমন বেদনার ঠিক তেমনি বিষাদের। আমাদের অতিপ্রিয় কাঞ্চনদা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে সেই অমৃতলোকে। যেখান থেকে সবাই আসে আবার সময় শেষে সেখানেই ফিরে যায়। জেলা বীরভূমে উল্কার মতোই তার আবির্ভাব আবার চলে যাওয়াটা সেই উল্কার মতোই। দীর্ঘ ত্রিশটা বছর তার সান্নিধ্য পেয়েছি। খুব কাছ থেকে দেখেছি। এই কাছে পাওয়ার জন্যই তার বেশ কিছু গুণ আমার চোখে পড়েছে। সেই ত্রিশ বছর আগে মুখোমুখি পরিচয় হবার অনেক আগে থেকেই তিনি আমার পরিচিত, চিঠিপত্র মারফৎ। মাত্র কয়েক লাইনের চিঠির উত্তর আমাকে টানতো। তারপর পরিচয়, তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, কত স্মৃতি, কত বিশেষ সংখ্যা, কত মেলাখেলা, মামলা, হুমকি, সংবর্ধনা আরও কত কি। আর সব শেষ তার চলে যাওয়া। এখানেই শেষ নয়, তার চলে যাওয়ার পরও তার উপর আক্রমণ চলছে। কাজ পাগল মানুষটা একটা পিছিয়ে পড়া জেলা থেকে চার পাতার একটা পত্রিকা প্রকাশ করে সকলকে চমকে দিল। ব্যতিক্রমি পত্রিকা। পত্রিকা তো নয় চাবুক। নয়াপ্রজন্ম ভক্তের ভগবান, শয়তানের যম। কালে কালে বেড়েছে তার কলেবর এবং কলরব। ত্রিশ বছর শেষে নয়াপ্রজন্ম ষোল পাতার রঙীন সাপ্তাহিক। বাংলায় সেরা সাপ্তাহিক। সে কথা বারবার বলতেন অধ্যাপক সোমেন বন্দ্যোপাধ্যায়। কাঞ্চনদার মন ছিল উন্নয়নমুখী। পিছিয়ে পড়া জেলার তকমা ঘোচাতে তার আপ্রাণ চেষ্টা। শত আর্থিক কষ্টেও তাই ষোলপাতার পত্রিকা আট পাতার হয়নি। নয়াপ্রজন্ম শুধু পত্রিকার ইতিহাসে বিস্ময় নয় গর্বেরও। যে সাপ্তাহিক পত্রিকা দেশের রাষ্ট্রপতির সংবর্ধনার আয়োজন করতে পারে তার কর্ণধারকে কোন্ বিশেষনে ভূষিত করা যায় আমার জানা নেই। সাংবাদিক জগতেও কাঞ্চন সরকার এক ব্যতিক্রমী মানুষ। তিনি সংবাদ সাহিত্য আর সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। স্পষ্ট কথা বলতেন তা সে সাধারণ মানুষ হোক কিম্বা কোন পদাধিকারী। সাংবাদিক সম্মেলনে ষে কথা কেউ বলতে পারছেন না ইচ্ছে থাকলেও কাঞ্চনদা সে কথা বলতেন অবলীলায়। মঞ্চে কেষ্ট বিষ্টু যে কেউ থাকুক না কেন। সাধারণ থেকে অসাধারণ গুরুত্ব দিতেন সবাইকে। উদ্যোক্তাদের বারবার বলতেন, জেলার সাংবাদিকরা অনুষ্ঠানে গেলে যেন একটি চেয়ার অন্তত পায়। মঞ্চ আলো করে বসে থাকে নানান মোসাহেবের দল আর কর্তব্যরত সাংবাদিক ঠাই দাঁড়িয়ে থাকে। এমন স্পষ্ট কথা কাঞ্চন সরকারই বলতে পারে। ১৯৭৫ সালে জরুরী অবস্থার সময় দোর্দন্ত প্রতাপ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে বীরভূমের কোন এক সাংবাদিক বলেছিলেন, আপনি জনগনের চাকর। কাঞ্চন সরকার তারই উত্তরসূরী। তিনি বীরভূমের একাই একশো, তিনি সব্যসাচী। তিনি বক্তা, লেখক, শ্রোতা, সাংবাদিক, সঞ্চালক, সংগঠক, কর্মী, সমাজসেবক, আবৃত্তিকার, আমাদের পথপ্রদর্শক, প্রকাশক এবং আরও অনেক কিছু। মাইক হাতে যেমন ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতে পারতেন ঠিক তেমনি কলম হাতে পাতার পর পাতা লিখে যেতে পারতেন। তার শব্দচয়ন, সরল ভাষা, কথার কৌশল বসিয়ে রাখতো পাঠক শ্রোতাদের। একজন দল নেতার যে সকল গুণ থাকা দরকার কাঞ্চনদার মধ্যে সবই ছিল। বক্তার পাশাপাশি দলনেতা হবেন শ্রোতা। কাঞ্চনদা সবার কথা মন দিয়ে শুনতেন। নয়াপ্রজন্ম বার্ষিক সভায় আমরা, সাংবাদিকরা পত্রিকার এবং কাঞ্চনদার ভুল ত্রূটির কঠোর সমালোচনা করতাম। তিনি সবার কথা মন দিয়ে শুনতেন এবং সবার শেষে যখন উত্তর দিতেন দেখতাম তার নয় ভুল ত্রূটি আমাদেরই। তার কাজ করিয়ে নেবার দক্ষতা ছিল, ছিল সমস্যার সমাধান করার মতো সাহস এবং আত্মবিশ্বাস। হলুদ সাংবাদিকতা, ব্যক্তিগত আক্রমণ, পয়সা নিয়ে সংবাদ করা বা না করা, সংবাদপত্রের গোপনীয়তা এসব নিয়ে তার উপদেশ আমাদের সমৃদ্ধ করেছে। বিধানসভা নির্বাচন সামনে। সেবার প্রথম নির্বাচনী বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ হবে। বললেন, বড় লেখা দাও। কাঁচু-মাচু হয়ে বললাম, রাজনীতির জ্ঞান আমার নাই। রাজনীতির কিছুই বুঝি না। কি লিখবো! চোখের উপর চোখ রেখে বললেন, অনেক নেতা যা জানে না তুমি তার চেয়েও বেশি জানো। কি দরাজ প্রশংসা, কি আত্মবিশ্বাস! আমার একটু আধটু সাহিত্য নেশা আছে, সংগ্রহের ঝুলিটাও পরিপূর্ণ। কাঞ্চনদা এসব জানতো, তাই আমাকে একটু বেশিই ভালোবাসতো। হয়তো কোন সুপ্ত পরিকল্পনাও ছিল। আক্ষেপ, খুব তাড়াতাড়ি চলে গেল। মাত্র ষাট বছরেই ছবি হয়ে গেল। এখনো যে তাকে খুব দরকার জেলার স্বার্থে, জেলাবাসীর স্বার্থে, সাংবাদিকদের স্বার্থে।