সম্পর্কই সম্পদঃ কাঞ্চনের এই বক্তব্য এখনকার দিনে কতটা তাৎপর্যপূর্ণ

নয়াপ্রজন্ম প্রতিবেদনঃ

পণ্ডিত শিবকুমার শর্মার শেষ যাত্রায় বাহক উস্তাদ জাকির হোসেন এমন দৃশ্য দেখলে মনে হয় ভারতবর্ষে জন্মানো সত্যিই সফল। মন আশায় ভরে যায়। মানুষ, মানুষেরই পাশে থাকে। কোনো দ্বেষ নাই, কোনো অভিমান নাই, কোনো বিবাদ নাই, কোনো স্বার্থ নাই এমনকি কোনো ভয় নাই। কিন্তু মানুষ মাঝে মাঝে কেন এত অচেনা হয়ে যায়। কিছু কিছু ঘটনা মানুষের মনের মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও মানুষ তাতে সারা দেয় না। যেমন দেখুন, ফুলে ফলে পরিপূর্ণ গাছ দেখতে আমরা ভালোবাসি। তার কত ছবি তুলি, তার সামনে দাঁড়িয়ে আজকালকার দিনে সেলফি তোলার জন্য হা-হুতাশ করি। কিন্তু সেই গাছে যখন ফুল ফোটে না ফল ধরে না তার দিকে আমরা একবার ফিরেও তাকাই না। যারা গাছের যত্ন করে, সেই ছোট্ট চারা গাছটিকে দীর্ঘ দিন ধরে নিজ হাতে বড় করে তোলে, তারাই তার মর্ম বোঝে। আমরা, সাধারণ মানুষ কেন তেমন করি না। কেন আমরা অবলা পশুর গায়ে অ্যাসিড অ্যাটাক করি। কেন, যে মানুষ হঠাৎ করে কোনো কারণে সেলিব্রিটি হয়ে গেল, তখনই আমরা তাকে নিয়ে মাতামাতি করি। কিন্তু তার আগে যেন তার কোনো মূল্যই ছিল না। চমক থাকলে তোমাকে এ সমাজ মনে রাখবে, মাথায় নিয়ে রাখবে। আর চমক নাই তো তুমি শূন্য। মানুষের ক্ষমতা থাকলে, সেটা টাকার দিক থেকেই হোক বা কোনো সমাজসেবা করেই হোক বা গায়ের জোড় দেখিয়েই হোক সমাজ তাকে চায়। কারণ তাকে আমরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য কাজে লাগাতে পারবো, তখন তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক। তারপর তার ক্ষমতা না থাকলে বা মানুষটি ইহলোক ত্যাগ করে চলে গেলে আমরা আর তাকে সম্মান করতে পারি না, তার সাথে সম্পর্কও অস্বীকার করি। তার কথা ভাববার মতো সময় আমাদের হাতে আর থাকে না। কারণ আমরা তো এখনকার দিনের যন্ত্রচালিত মানুষে পরিনত হয়েছি। নিজের ছাড়া অন্য কিছু বুঝি না। নিজের পরিবার, নিজের চাকরি, নিজের ব্যাবসা। কোনোদিন যে সেই ক্ষমতাশালী মানুষটার কাছ থেকে কিছু সাহায্য পেয়েছি তা প্রায় ভুলেই যাই বা অস্বীকার করি। কারণ তার কাছে তো আর কোনো ক্ষমতা নাই, যার জোরে সে আমাকে ভবিষ্যতে কোনোদিন কোনো কাজে সাহায্য করতে পারবে। কেন বলুন তো, আমরা কেন নিজের সীমার বাইরে বেরিয়ে অন্য কারোর পাশে দাঁড়াতে এত ভয় করি। আমরা সাধারণ মানুষ বলে। কি ভয় আমাদের। সমাজ কিভাবে চলবে তাহলে। সবাই যদি নিজ নিজ পরিবারটাই নিজের গণ্ডি ভেবে নেয় তাহলে ভবিষ্যতের প্রজন্ম কি শিখবে আমাদের কাছে থেকে। তারা নিজের লোক বলতে শুধু মা-বাবা-ভাই-বোনকেই চিনবে। পাশের বাড়ির দিদা-দাদুর সাথেও যে তার একটা সম্পর্ক আছে সেটা তারা শিখবে কিভাবে? কে শেখাবে?

সাম্প্রতিককালের একটি ঘটনা, বীরভূমের কাঞ্চন সরকার একজন নাম করা নির্ভিক সাংবাদিক। আপনারা যাকে চলতি ভাষায় বলেন দুদে সাংবাদিক। যিনি বলতেন সম্পর্কই সম্পদ। তার ৩০ বছরের পুরনো একটি সাপ্তাহিক পত্রিকাও বর্তমানে রয়েছে। বীরভূমের অনেক সাংবাদিক তার হাতেই তৈরী। যারা এখনকার ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া বা ডিজিট্যাল মিডিয়া বা নিউজ প্রিন্ট মিডিয়ায় নাম করা সাংবাদিক হিসেবে পরিচিতি পায়। জানুয়ারীর ২৮ তারিখ হঠাৎ কাঞ্চন সরকার আমাদের সকলকে ছেড়ে চলে গেলেন। তাঁর মৃত্যুতে অনেক ব্যক্তি সেদিন পাশে এসেছিলেন, অনেক জায়গায় তাঁর উদ্দেশ্যে বিভিন্ন স্মরণসভা হয়েছে এখনও হচ্ছে। বিভিন্ন সম্মাননা, মরনোত্তর সম্মাননাও পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে। আর প্রত্যেক স্মরণসভায় আলোচনা হচ্ছে তাঁর অসম্পূর্ণ কাজ গুলো নিয়ে। কাঞ্চন সরকার যেমন সাংবাদিক ছিলেন, তেমন সমাজসেবী মানুষও ছিলেন, আর তাঁর খুব প্রিয় ছিল সাংস্কৃতিক জগত। আমার খুব ছোটবেলার একটা দৃশ্য এই সময় খুব মনকে নাড়া দিচ্ছে, আজ থেকে প্রায় ৩৫ বছর কি তারও আগে ঠিক মগজে আনতে পারা যাচ্ছে না, যাইহোক সিউড়ির মেন রাস্তা দিয়ে একটা পদশোভা হয়েছিল। লোকজন বিভিন্ন পোশাকে সুসজ্জিত ছিল। আর তাদের হাতে একটা করে প্ল্যাকার্ড, তাতে লেখা আমাদের একটি মঞ্চ চাই। আমি খুব ভুল না করলেও একটি ব্যক্তির মুখ আমার চোখে ভাসছে। তিনি হলেন বাবুন চক্রবর্ত্তি। তিনি ছিলেন পদযাত্রায়। কাঞ্চন সরকার আজ এই ২০২২ সালে সাংস্কৃতিক প্রেমী মানুষদের জন্য বীরভূমের বুকে তৈরী করেছেন অত্যন্ত আধুনিক মানের একটি মঞ্চ। নাম বসুন্ধরা। বীরভূমবাসীদের কাছে এটি একটি পরিচিত নাম। আর এটা ছিল কাঞ্চন সরকারের মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার উপহার। যেটা তিনি চলে যাওয়ার আগে বীরভূমবাসীদের হাতে সম্পূর্ণ করে তুলে দিয়ে গেছেন। হয়ত সেই পুরোনো বাবুনদার মতো নাট্যপ্রেমী মানুষদের কথা মনে করে। তাঁর চলে যাওয়ার কিছু দিন আগে থেকেই তিনি হয়তো বা বুঝতে পেরেছিলেন তিনি আর বেশিদিন নাই। তাই তড়িঘড়ি জানুয়ারীতে হল বসুন্ধরার অভিষেক। তিনি বসুন্ধরাকে তাঁর মানস কন্যা বলতেন। তাহলে তাঁর অনুপস্থিতিতে কেন নাট্যপ্রেমী মানুষরা এত পিছিয়ে। কাঞ্চন সরকার মঞ্চে দাঁড়িয়ে সকলের সামনেই বলতেন নাট্য জগতের ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর হলেন বাবুন চক্রবর্ত্তী-রজ সাহা-সুবিনয় রায়। তাঁরা কেন আজ কাঞ্চনের মানসকন্যা কে নিজেদের প্রযত্নে নিচ্ছেন না। সবুজের অভিযান তো কাঞ্চনের এক সন্তান। তাকে রক্ষা করার দায়িত্বও তো আমাদের। ২০২২ ফেব্রুয়ারী মাসের পর থেকে কি বীরভূম শহরে কোনো নাটক মঞ্চস্থ হয়নি?  কাঞ্চনের নিজের হাতে তৈরী করা নয়াপ্রজন্ম, সবুজের অভিযান তো বীরভূমের গর্ব। আজ তারা পিতৃহীন হয়েছে, আসুন আমরা সকলে তাদের নিজের কোলে তুলে নিই। অফুরন্ত ভালোবাসা দিয়ে তাদের যত্ন করি। সন্তান মানে কি শুধু রক্তমাংসের পিণ্ড হলেই তাকে যত্ন করতে হয়! যেকোনো প্রতিষ্ঠান একজন ব্যক্তির সন্তান নয়! দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে যাকে তৈরী করলেন সেটা তাহলে কি? শুধুই কি কংক্রিট! কাঞ্চন সেই কলেজ লাইফ থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা “আমি”, “সবুজের অভিযান” এগুলোকে মনের গভীরে রেখে নিজের পথচলা শুরু করেছিল। সেটা গোটা বীরভূমবাসী জানেন। আজ কাঞ্চন সরকার চলে যাওয়ার পর তারই তৈরী করা সবুজের অভিযানে দীর্ঘ ৩ মাসে মাত্র ২টো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। আপনাদের কিসের ভয়-লজ্জা-ঘেন্না-হিংসা কাজ করছে। বয়সের ভারে কেউ যদি ভাবেন এত বড় মঞ্চের দায়িত্বভার নেওয়া কঠিন। তবে জানাই, নয়াপ্রজন্ম আছে আপনাদের পাশে আর থাকবেও সারাজীবন। আর এটা ৩০০ আসন বিশিষ্ট মঞ্চ। ১০০০ আসন বিশিষ্ট মঞ্চ তো কাঞ্চন সরকার করে যায়নি। তাহলে আপনারা অবশ্যই পারবেন ৩০০ আসন বিশিষ্ট একটি মঞ্চকে সাজিয়ে তুলতে কাঞ্চনের মতো করে। বসুন্ধরা মঞ্চের সামনের পাঁচিল নিয়েও অনেক বক্তব্য। পাঁচিল আছে তো কি আছে, কলকাতার সব মঞ্চের সামনে কি আপনার যানবাহন দাঁড় করাতে পারেন? হেঁটে আসুন, টোটোতে আসুন, বসুন্ধরাকে ভালোবেসে আসুন, নিজের ভেবে আসুন। অনেকের বক্তব্য, কাঞ্চন করে গেছে বলেই কি আমাদের সেটা সংরক্ষণ করতে হবে? নিজেদের কাজ ছেড়ে? ঝামেলা তে জড়াবো কেন? তাহলে একটা কথা সমাজ তাহলে কি? আপনার সন্তানকে যদি টিচার পড়াতে না চায়, ডাক্তার যদি আপনার স্ত্রীর চিকিৎসা করতে না চায়, দোকানদার যদি আপনার বাবা-মাকে জিনিস না দেয় তাহলে আপনার পরিবার টিকবে কি করে? এখন মানুষ অনেক উন্নয়নমুখী হয়েছে। মারা যাওয়ার পর তার নিজের অঙ্গ দান করে যাচ্ছেন অন্য একজনের পরিবারকে ভালো রাখার জন্য। এই সহৃদয় কাজ গুলো করার জন্য কি শুধু একশ্রেণীর মানুষই স্বার্থত্যাগ ক’রে সমাজকে শুধু দিয়েই যাবে। বাকি মানুষ শুধু সমাজে বসবাস করে সুখে দিন যাপন করবে? একটু ভাবুন। কাঞ্চন সরকার জীবিত থাকাকালীন সমাজের বহু মানুষের বহু উপকার করে গেছেন। আজ তিনি নাই, তাই তাঁর কাছ থেকে তো আর কোনো উপকার পাবো না বলে তার তৈরী জিনিস গুলোকে অবহেলা করবেন না। কাঞ্চনের কি দোষ ছিল, কি ভুল করেছে, কি করলে পারতো আমরা এগুলো সব ভুলে যাই। শুধু তার ভালো জিনিসগুলোই আমরা মনে রাখার চেষ্টা করি। তাহলে সব সম্ভব। এই মঞ্চে প্রচুর মানুষের আর্থিক সাহায্য আছে, সরকারী প্রচুর ডোনেশন আছে, প্রচুর মানুষের শারীরিক পরিশ্রম আছে। তাই এই মঞ্চ এত সহজে হারিয়ে যাবার নয়। নিজেদের পরিবারের সম্পর্কগুলোকে বজায় রেখে বসুন্ধরা মঞ্চকে কেন্দ্র করে আসুন সকলে মিলে বৃহৎ এক পরিবার গড়ি, নতুন করে আরও কিছু সম্পর্ক তৈরী করি। কারণ কাঞ্চনের মূল মন্ত্রই ছিল সম্পর্কই সম্পদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *