আদিত্য মুখোপাধ্যায়ঃ
‘নয়াপ্রজন্ম’ প্রকাশের আগে বীরভূম জেলায় অনেকগুলি সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, এমনকি দৈনিক চন্দ্রভাগাও ছিল, কিন্তু কোনোটাই প্রায় জেলার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তকে ছুঁয়ে থাকতো না। খানিকটা হলেও সেই সময়ই ‘দিদিভাই’ জেলার মাটি ও মানুষকে নিয়ে চলার চেষ্টা করেছে। ‘অগ্নিশিখা’, কুঠার’, ‘তীর্থভূমি’, সাপ্তাহিক ‘চন্দ্রভাগা’, ‘পীঠভূমি’, ‘ময়ূরাক্ষী’, ‘সেবা’, ‘ইলামবাজার বার্তা’, ‘বহ্নিশিখা’ আর ছিল প্রেস ক্লাবের সম্পাদক সূর্য চক্রবর্তীর কাগজ এবং ঘুমটি ঘরে তার অফিস। এক্ষেত্রে বিপ্লব এনেই নয়াপ্রজন্ম আজ থেকে ত্রিশ বছর আগেই, ট্রেডল মেসিনের আমলেই, বিশেষভাবে নজরে এলো সবার। চারপৃষ্ঠা, আটপৃষ্ঠা থেকে আজ ষোল পৃষ্ঠা এবং তার চার চারপৃষ্ঠা রঙিন। এমন কাগজ কাঞ্চনের আগে এ জেলায় কেউ বের করতে পারেনি। কাঞ্চনের পরও কেউ বের করতে পারবে বলে মনে করি না। সমগ্র বাংলাতেই নয়াপ্রজন্মের মতো পত্রিকা দুর্লভ। কাঞ্চন সরকার তথা নয়াপ্রজন্মের সম্পাদকের মতোন সাংবাদিকও এ বাংলায় খুব বেশি নেই।
নয়াপ্রজন্মের জন্মকাল থেকেই তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক। সে ছিল আমার ভাই, বন্ধু, অভিভাবকও। দেখেছি কী অসম্ভব প্রতিভা তার। সঙ্গে সঙ্গে কম্পিউটার স্ক্রিনেই সংবাদ লিখে ফেলছে। বাক্য বানান সম্পর্কেও সুষ্ঠ ধারণা ছিল তার। আর ছিল বীরভূমের প্রতি অসম্ভব ভালোবাসা। বলতো ‘সম্পর্কই সম্পদ’। আর ‘সত্যই সুন্দর’। প্রখর স্মৃতির অধিকারী কাঞ্চন সরকারের সাংগঠনিক ক্ষমতাও ছিল অতুলনীয়। সঞ্চালনার ক্ষেত্রেও অনুষ্ঠানকে সুন্দর করে তুলতে পারতো কাঞ্চন। ভুল বলতো না কারোর নামের ক্ষেত্রে। এমন একজন স্বাধীনচেতা, রূঢ়ভাষী, অকৃতদার সম্পাদক জেলাকে দেখিয়ে দিয়েছে কাগজ কাকে বলে, কাগজ কিভাবে করতে হয়? দোষী মানুষজন ভয় করতো কাঞ্চনকে। সত্য কথা লিখতে তার হাত কাঁপতো না। এমন একজন সম্পাদক, সাংবদিক, সংবাদপত্রের শূণ্যস্থান পূরণ হবে না বলেই মনে করি। এমন বহুমূখী প্রতিভা নিয়ে এ জেলায় কাউকেই তো উঠে আসতে দেখছি না। জেলার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত কাঞ্চন ছুটছে, অনুষ্ঠানে গেছে, মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গেছে। আসলে এ জেলার মাটি ও মানুষকে সে যেভাবে চিনেছিল, তেমনভাবে পরিশ্রম করে ঘুরে ঘুরে জেলাকে চেনেনি অনেকেই। তাই তাদের চর্চা খণ্ডিত হলেও কাঞ্চন সরকার সর্বত্রগামী। ‘নয়াপ্রজন্ম’ পত্রিকাটি যেত না এমন গ্রাম নেই বীরভূমে। বুধবার সকাল হলেই মানুষ তাকিয়ে থাকত ‘নয়াপ্রজন্ম’ আজ কী লিখেছে সেটা দেখবার জন্য। তখন বলাই হতো নয়াপ্রজন্মের বাইরে থাকা মানেই জেলার বাইরে থাকা, মূল স্রোতের বাইরে থাকা।
এমন কাঞ্চন সরকার নিজেকে জানবার বুঝবার আগেই চলে গেল, তাতে ওর চেয়ে জেলার ক্ষতিই হলো বেশি। কারণ, তার সমতুল যোগ্যতার কেউ নেই, যে ওর মতো করে কাগজটিকে চালাতে পারে, প্রতিষ্ঠানগুলিকে বাঁচাতে পারে। তবু তো একটি দিশা সে দিয়ে গেল। এখন যদি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কিছু মানুষ স্বপ্ন ফেরিওয়ালা কাঞ্চন সরকারের অসম্পূর্ণ স্বপ্নগুলির পাশে এসে দাঁড়ায়, তাহলেও কিছুটা কাঞ্চনকে খুঁজে পাওয়া যাবে। যে কোনো জিনিসই ভাঙা সহজ, গড়া খুব কঠিন।
ষাট বছর জুড়ে তিলে তিলে যে তিলোত্তমা গড়েছে কাঞ্চন, আজও তা অসম্পূর্ণ। অথচ পরোপরাকে মগ্ন থেকেই বহু মানুষের কাছে সুজন হয়েই কাঞ্চন জেলার শ্রেষ্ঠ সংবাদপত্র নয়াপ্রজন্ম নির্মাণ করেছিল। কাঞ্চন সরকার নেই, তাই সবই যেন অস্পষ্ট লাগছে।