নয়াপ্রজন্ম প্রতিবেদনঃ
দীঘা, পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার অন্যতম জনপ্রিয় সমুদ্রতট পর্যটন কেন্দ্র। এই সৈকত শহর শুধু সমুদ্রস্নানের জন্য নয়, এখন হয়ে উঠছে একটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থানও। এর প্রধান কারণ হল নতুনভাবে নির্মিত জগন্নাথ মন্দির, যা বর্তমানে পর্যটকদের ও ভক্তদের আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু।

নির্মাণ ও অবস্থান
দীঘার নিউ দীঘা এলাকার সংলগ্ন বার্ষিকুন্তি অঞ্চলে, বিশাল এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছে এই জগন্নাথ মন্দির। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তত্ত্বাবধানে, ওড়িশার পুরী মন্দিরের আদলে নির্মিত হয়েছে এই মন্দির। ২০২৫ সালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই মন্দিরের উদ্বোধন করেন। এটি শুধু একটি ধর্মীয় স্থান নয়, বরং পর্যটন উন্নয়নের অন্যতম অংশও।
স্থাপত্য ও দেবতা
মন্দিরটি লাল বালি-পাথর ও সাদা মার্বেল দিয়ে নির্মিত, যার কারুকার্যে ফুটে উঠেছে ওড়িশার স্থাপত্যশৈলীর অনুকরণ। মূল মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত আছেন জগন্নাথ দেব, বলভদ্র ও সুভদ্রা—যেমনটি দেখা যায় পুরীর মন্দিরে।
দীঘা জগন্নাথ মন্দির কেবল প্রধান ত্রয়ীর পূজার স্থান নয়; এখানে আরও বহু গুরুত্বপূর্ণ দেবতার পৃথক মন্দির বা বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেমন:
- দেবী মহালক্ষ্মী – বিষ্ণুর সহধর্মিণী ও সমৃদ্ধির দেবী। দীঘা মন্দির চত্বরে তাঁর জন্য একটি পৃথক মন্দির নির্মিত হয়েছে। বৈষ্ণব রীতিতে মহালক্ষ্মীর উপস্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- দেবী বিমলা – জগন্নাথের শক্তিরূপ, দুর্গার একটি রূপ বলে বিবেচিত। দুধ স্নানের (milk bath) রীতিতে বিমলার উল্লেখ তাঁর উপস্থিতির প্রমাণ দেয়।
- সত্যভামা – ভগবান কৃষ্ণের অপর এক পত্নী। দীঘা মন্দিরে সত্যভামার পূজাও বিশেষভাবে সম্পাদিত হয়, বিশেষত স্নানযাত্রা ইত্যাদি অনুষ্ঠানে।
- রাধা-কৃষ্ণ – মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠা’ অনুষ্ঠানে রাধা-কৃষ্ণের পাথরের বিগ্রহের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁদের একটি পৃথক মন্দির দীঘা মন্দির প্রাঙ্গণে রয়েছে, যা এই স্থানের বৈষ্ণব ঐতিহ্যকে আরো সমৃদ্ধ করেছে।
- ভগবান শিব (লিঙ্গরূপে) – জগন্নাথ মন্দিরে শিবেরও একটি মন্দির রয়েছে, যা দেবতাদের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং বৈদিক ধারার মেলবন্ধনকে নির্দেশ করে।
- বৈষ্ণব অবতারগণ – মন্দির চত্বরে আরও কয়েকটি ক্ষুদ্র মন্দির রয়েছে, যেখানে পূজিত হন বিষ্ণুর অন্যান্য অবতার, যেমন:
- বামন – বামন রূপে বিষ্ণুর ধার্মিকতা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার চিত্র।
- বরাহ – ভূ-উদ্ধারকারী অবতার।
- নরসিংহ – হিংস্রতা ও শত্রু বিনাশের প্রতীক।

বিশেষ আকর্ষণ
- রথযাত্রা উৎসব: রথযাত্রার সময় এখানে হাজার হাজার ভক্তের সমাগম হয়। রঙিন রথ, ঢাকঢোল আর ভক্তিরস এই দিনটিকে পরিণত করে এক মহোৎসবে।
- আলোকসজ্জা ও সৌন্দর্যায়ন: সন্ধ্যার পর মন্দিরচত্বর অপূর্ব আলোয় ঝলমল করে ওঠে। চারপাশে সাজানো হয়েছে উদ্যান, বসার জায়গা ও ফুড কোর্ট, যা পর্যটকদের আরামদায়ক সময় কাটাতে সাহায্য করে।
পর্যটকদের জন্য বাড়তি সুবিধা

জগন্নাথ মন্দিরটির আশপাশে গড়ে উঠেছে আধুনিক পরিকাঠামো—পার্কিং এলাকা, বিশ্রামাগার, জল ও শৌচাগারের ব্যবস্থা, যা একে করে তুলেছে একজন পর্যটকের আদর্শ গন্তব্য।
দীঘা জগন্নাথ মন্দির শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় স্থান নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক ও পর্যটন মানচিত্রের এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। সমুদ্রের ধারে দেবদর্শন এবং প্রকৃতির সৌন্দর্য—এই দুইয়ের সমন্বয়ে দীঘার এই নতুন মন্দির নিঃসন্দেহে বাংলার গর্ব।
