এমন ভাবে চলে যাওয়াটা কি ঠিক হলো, কাঞ্চনদা?

সন্দীপন রায়:

এক অদ্ভুত মানসিক অবস্থা থেকে আজ এই লেখা। তাঁর আমন্ত্রণে মঞ্চে উঠেছি, মাইক্রোফোনে কিছু কথাও বলেছি, তাঁর আমন্ত্রণে তাঁর মস্তিষ্ক সন্তান ‘নয়াপ্রজন্ম’ পত্রিকায় লিখেছি, তাঁর পাশে বসে মধ্যে মাঝে তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছি অনুষ্ঠান মঞ্চে বা অন্য কোথাও, কিন্তু, তাঁকে নিয়ে এই লেখা লিখতে সত্যিই আজ ভীষণ দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ছি। কারণ এই লেখা তাঁর অবর্তমানে তাঁর স্মৃতিচারণ । আমাদের সকলের প্রিয় কাঞ্চনদা আজ আর আমাদের মধ্যে শারীরিক ভাবে নেই। যদিও একথা সত্যি বলতে এখনো বিশ্বাস করে উঠতে পারছিনা। যদিও বয়সের দিক দিয়ে তাকে কাঞ্চন কাকু বলায় শ্রেয়। ছোটবেলায় বলতামও তাই। কিন্তু সময়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধির সাথে সাথে তাঁরই আবদারে,আশ্রয়-প্রশ্রয়ে কখন যেন ‘কাকু‌‌‌’ থেকে রূপান্তরিত হয়েছেন ‘দাদা’তে কাঞ্চন সরকার। শুধু আমি কেন? এই অভিজ্ঞতা তো আজ প্রায় সমস্ত বীরভূমবাসীর কাছেই সত্য। কাঞ্চনদার এইভাবে হঠাৎ করে না ফেরার দেশে চলে যাওয়া অবশ্যই অবিশ্বাস্য।

তবে একথাও সত্য, কাঞ্চন সরকারের কর্মজীবনের সঙ্গে জড়িত মানুষেরা স্বীকার করবেন তাঁর মতো সদাচঞ্চল, কর্মে, উদ্যোগে, আয়োজনে, সংগঠনে নিমগ্ন প্রাণের প্রদীপ হয়তো এভাবেই নিভে যায়। অন্যের প্রাণের প্রদীপ জ্বালাতে গিয়ে। ব্যক্তিগত স্তরে তাঁর সঙ্গে মতপার্থক্য হয়নি এমন মানুষ বিরল। কিন্তু তা মনান্তরে না পৌঁছে দেওয়ার দায় ও দায়িত্ব থেকে এক মুহূর্তের জন্য পিছিয়ে আসেননি কাঞ্চন সরকার। তাঁর আক্রমণাত্মক কথাবার্তায় হয়তো অনেক সময়ই অনেক ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ তৈরি হয়েছে। কিন্তু একথা সকলেই দ্বিধাহীন ভাবে স্বীকার করবেন যে তাঁর মতো দক্ষ সংগঠক সংস্কৃতি, সাহিত্য, সংবাদ জগতে সত্যিই বেশি নেই। এর সঙ্গে তাঁর বীরভূম প্রেম, বীরভূমকে নিয়ে নানান ভাবনাচিন্তার উদ্যোগ আয়োজন তাঁকে তাঁর নিজের ক্ষেত্রে নির্বিকল্প করে তুলতে পেরেছে। একই মঞ্চে এসে হাজির করিয়েছেন বিভিন্ন ক্ষেত্রের দিকপালদের। এও এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

তাঁর ‘সবুজের অভিযান’, ‘বসুন্ধরা’, ‘বর্ণপরিচয়’ একের পর এক প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যে প্রচেষ্টা, সকলকে এক ছাদের তলায় আনবার যে ইচ্ছা, যে সংগঠিত আয়োজন তা বিস্মিত করেছে আমাকে, আমাদেরকে। এতো এতো পরিকল্পনার কি সত্যিই সফল রূপায়ণ সম্ভব, ভেবেছি বারংবার। কাঞ্চনদা চেয়েছিলেন আমার, আমাদের আরও সক্রিয় অংশগ্রহণ। আমার ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতায় হয়তো ততটা অংশগ্রহণ করতে পারিনি সক্রিয় ভাবে, সর্বাঙ্গীন ভাবে সমস্ত প্রকার আয়োজনে। তাঁর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছি, করছি আজও কাঞ্চনদার কাছে। আর অবাক চোখে দেখেছি কীভাবে কী অসীম সাহসে এগিয়ে গেছেন স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে।

মাঝে মাঝেই কাঞ্চনদা ফোন করে জানতে চাইতেন ইংরাজী সাহিত্যের নানা জিজ্ঞাসা, কোনো বাংলা শব্দের ইংরাজী প্রতিশব্দ অথবা অন্যটা। করোনাজনিত লকডাউনের সময় ফোনে খোঁজ নিয়েছেন আমার পরিবারের স্বাস্থ্যের। হোয়াটসঅ্যাপে ভাসিয়ে দিয়েছেন নানা বার্তা। ‘বসুন্ধরা’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমার মতো নগন্য একজনকে সম্মাননা প্রদান করেছেন। এভাবেই ব্যক্তিগত স্তর থেকে প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে গড়ে উঠেছে সম্পর্ক। তিনিই তো বলতেন ‘সম্পর্কই সম্পদ’।

ব্যক্তিগত এই সম্পর্ক রসায়নের বাইরে দাঁড়িয়ে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই কাঞ্চন সরকারের এই আকস্মিক প্রয়াণ খুব অনিবার্য ভাবেই এক অপূরণীয় শূন্যতা তৈরি করলো বীরভূমকে নিয়ে নিরন্তর ভাবনা, চর্চা, যৌবন মিশ্রিত উদ্যোগ আয়োজনের ক্ষেত্রে। বাগ্মী, সুসঞ্চালক, সাবলীল কলমের অধিকারী, যোগ্য সম্পাদক, সংগঠক মাননীয় কাঞ্চন সরকারের অসমাপ্ত কাজকে সম্পূর্ণ করাটাই হবে তাঁর প্রতি আজকের দিনে আমাদের যথার্থ শ্রদ্ধা নিবেদন। শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানাই কাঞ্চনদা। আপনার কাজই আপনাকে বাঁচিয়ে রাখবে। এটাই আমাদের বিশ্বাস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *