কাঞ্চন সরকারঃ গতির নাম, প্রগতির নাম

চন্দন চট্টোপাধ্যায়:

নব্বই দশকে বীরভূমে উল্লেখযোগ্য নিয়মিত সংবাদপত্র বলতে তখন কোটাসূরের ‘দিদিভাই’। সেই সময় মাত্র ৩০ বছরের যুবক কাঞ্চন সরকার ১৯৯১ সালে নিজের সম্পাদনায় ‘নয়াপ্রজন্ম’ নামে একটি সাপ্তাহিক সংবাদ পত্র প্রকাশ শুরু করলেন। সেই সাথে সংগঠিত করে ফেললেন জেলাজুডেৃ তরুন প্রজন্মের একঝাঁক সাংবাদিক ও লেখককেও। আমার সৌভাগ্য সেই দলে আমিও ছিলাম একজন সৈনিক। শুধু আমিই নয়, জেলাজুড়ে ১৯টি ব্লকের ১৯ জন তাজা তরুনকে সাংবাদিকতায় উদ্বুদ্ধ করলেন। জেলা জুড়ে ঢি-ঢি পড়ে যাওয়া ‘নয়াপ্রজন্ম’ যেন হয়ে উঠলো ‘হট্ কেক’। লেখার বিষয়, তথ্য, তত্ব, অনুসন্ধিৎসার আবেগ, পরিবেশন শৈলী এবং সাহসী সুদক্ষ সম্পাদনায় কালক্রমে পত্রিকাটি হয়ে উঠলো জেলার সার্বিক গণদর্পন। সদরের লেখক মহলে আমাদের সাংবাদিক গোষ্ঠীকে সরসতাও শুরু হল-কাঞ্চন সরকারের ‘ন’-গোষ্ঠী! অথাৎ কাঞ্চন, নন্দন, চন্দন, সনাতন, তীর্থ পৈতণ্ডী, কুমুদবন্ধু, সানে আলম, নূর মহম্মদ, মহঃ নূরেন্নবী, আরিফউদ্দীন, রিয়াজউদ্দীন, শম্ভুনাথ প্রমুখ (লক্ষ্যনীয় প্রত্যেক নামের মধ্যে ‘ন’ আছে)! এছাড়াও সামিল হলেন রাকিফুল হাসান, বাপী চন্দ্র, মমতাজ বেগম, বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, ভাষ্করজ্যোতি মজুমদার, বিদ্যুৎ দাস, সুভাষচন্দ্র মাজি, প্রদ্যোৎ মাল, দেবশুভ্র ব্যানাজী, অজয় দাস প্রমুখ (কোন নাম বাদ গেলে ক্ষমাপ্রার্থী)। এছাড়াও সামিল হলেন মহঃ সফিউল আলম, দীপক দাস সহ আরও এ পর্যন্ত অনেক তরুন তুর্কি। পত্রিকাও চার পৃষ্ঠা থেকে দফায় দফায় এখন ১৬ পৃষ্ঠায় সুসমৃদ্ধ।  

এত ব্যাপক প্রচার, প্রসার, শ্রীবৃদ্ধির মূল নায়ক ছিলেন কাঞ্চন সরকার। একটি পএিকা ও প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসাবে কাণ্ডারীকে যেমন হতে হয়, কাঞ্চনদা ছিলেন তারও বেশীরকমের যোগ্য। আদর্শ এবং ব্যক্তিত্বে দীপ্ত। কোনও হুমকি বা অন্যায়কে যেমন আপস করেননি, তেমনি প্রকৃত কৃতি গুনীদেরও সমাদর ও সদ্ধ্যাবহার করতে বিন্দু্মাত্র দ্বিধা করেননি। ঘরোয়া সাংবাদিক সভায় নিখুঁত, গঠনমূলক এবং ক্লাশ নেবার ভঙ্গীতে শেখাতেন সংবাদ  সংগ্রহের সূত্রানুসন্ধান, সংবাদ তৈরির প্রকৌশল, প্রাসঙ্গিকতা, লেখকশৈলী, ভাষা প্রয়োগ ইত্যাদি। ‘না-বলা’ মানুষকে কীভাবে বলাতে হয়, আর ‘হরবোল’ দের কীভাবে থামাতে হয়–শিখিয়েছেন তিনিই। অনেক বিষয়ে আমাদের সঙ্গে মতবিরোধ হয়েছে, ক্ষোভ-রাগারাগি হয়েছে, অনেকে রাগে লেখে ছেড়েই দিয়েছিলেন, কিন্তু পরে তাঁদের আবার কাছে টেনে নিয়েছেন নির্দ্ধিধায়। আশ্চর্য হয়ে আমরা উপভোগ করেছি তাঁর সানিধ্য।

বাংলা বিষয়ে তীক্ষ্ণ মেধাবী ছাত্র এবং সাম্মানিক স্নাতক কাঞ্চন সরকারকে কখনই আত্মসন্তুষ্টি এবং আত্মপ্রচারে ভুগতে দেখিনি। সব সময়ই তাঁর মাথায় কিলবিল করতো পরিকল্পনার পর পরিকল্পনা। নব নব উদ্যোগ-তরঙ্গ। কিশোর বয়সে মনিমালা মেলা দিয়ে শুরু। তারপর দূরত্ব উত্তরনে সবুজের অভিযান, স্থানীয় ও দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিকতা, পথিক হোটেল, সারা ভারত সাইকেল  ভ্রমন এবং প্রেস প্রেমিস। তাঁর  উন্মত্ত উদ্যোগের ঘোড়া এরপরও টগবগিয়েছে নবজাতক, আবৃতি প্রশিক্ষণ, বসুন্ধরা প্রেক্ষাগৃহ সহ আরও অনেক দূরগামী প্রকল্পে। শারীরিক সমস্যা, নিয়মিত ওষুধ খাওয়া, নিয়মিত আহার, বিশ্রাম, ঘু্মকে তুচ্ছ করেও নিজেকে উৎসর্গ করেছেন জেলার সংবাদ-সংস্কৃতির  উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিকল্পে। এ জন্যই কাঞ্চন সরকার হল একটি গতির নাম। একটি প্রগতির নাম। তাঁর অনবদ্য উজানে প্লাবিত ও উদ্ভাসিত হয়েছে বীরভূমের হাজার সংস্কৃতির প্রাঙ্গন। তাঁকে ঘিরে প্রবাদও চালু হয়েছিল, “সবেতেই দরকার/কাঞ্চন সরকার”। সেই তরঙ্গায়িত বর্ণময় প্রতিভার প্রয়ান-বিপর্যয় নিঃসন্দেহে এক অপূরণীয় ক্ষতি ‘নয়াপ্রজন্ম’র পক্ষে। পাশাপাশি উঠে আসে উত্তরদায়ও। এ বিষয়ে তাঁর পরিবারের দায়বদ্ধতাও কোনও অংশে কম নয়। বর্তমান সাংবাদিকরা ও তাঁর পারিবারিক পৃষ্ঠপোষকদের সাহচর্যে ‘নয়াপ্রজন্ম’-র যেন মৃত্যু না হয়—এইহোক কাঞ্চন সরকারকে বাঁচিয়ে রাখার একমাত্র শপথ।    

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *