উত্তম মণ্ডল
কিছুক্ষণ আগেই ভূত ও ভয় নিয়ে কথা হচ্ছিল স্থানীয় ব্যবসায়ী ভজহরি বিষ্ণুর সঙ্গে। কথায় কথায় জানালেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। একবার ভর সন্ধ্যেয় সাইকেলে চেপে জয়পুর থেকে ফিরছিলেন তিনি। জঙ্গলের তেমাথাতে আসতেই পড়ে গেলেন তিনি। পড়ে পড়ে দেখলেন, একটি কালো কুকুর রাস্তা পেরোচ্ছে। ভজহরি খানিকটা ভয় পেলেন। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল, জননীর সাবধানবানী, রাস্তায় সাইকেল ছাড়বি না। অমনি ভজহরি শুয়ে শুয়েই পা দিয়ে সাইকেলটা ছুঁয়ে রইলেন। ভয় কেটে গেল। উঠে ফের সাইকেল চালিয়ে বাড়ি।
ওপরের ঘটনাটি থেকে বোঝা গেল, লোহা ভয় দূর করে, মানুষের মধ্যে এই সংস্কারটি বদ্ধমূল রয়েছে।
বলতে গেলে, জন্ম, বিয়ে এবং মৃত্যু—তিনটি ক্ষেত্রেই রয়েছে লোহার ব্যবহার।
এখনও গ্রামের দিকে প্রসূতির ঘরের দরজার বাইরে একটি লোহার পেরেক পুঁতে দেওয়া হয়। আর ২১ দিন পর্যন্ত প্রসূতি আঁতুরঘরের বাইরে গেলে হাতে লোহার কাস্তে রাখে। এছাড়া শিশুর মাথার কাছে রেখে দেওয়া হয় লোহার কাজললতা। এ তো গেল জন্মের কথা।
বিয়েতেও রয়েছে লোহার ব্যবহার। বিয়ের আগের দিন অর্থাৎ গায়ে হলুদের দিন থেকেই ভাবী বরের হাতে থাকে লোহার যাঁতি এবং কনের হাতে লোহার কাজললতা। আর নববধূর হাতে শাঁখার সঙ্গে লোহার নোয়া অর্থাৎ বালা ধারণ করার রীতি আছে।
মৃত্যুর পর আছে লোহার ব্যবহার। যেমন, মা-বাবা মারা গেলে অশৌচকালে সন্তান গলায় উত্তরীয়র সঙ্গে একটি লোহার চাবি বেঁধে রাখে। আর যে স্থানে ব্যক্তিটি মারা গেছে, সেখানে একটি লোহার পেরেক পু়ঁতে দেওয়া হয়। অনেক সময় মৃতের পরিবারের সবাই আঙুলে একটি করে লোহার আংটি পরেন।
আমাদের দেশের পাঁচ মাসের গর্ভবতী রাজপুত নারীদের মাথায় একটি মুকুট পরানো হয়, যেখানে থাকে একটি লোহার ছুঁচ। গুজরাটে বর-কনের হাতে মদনফুল বাঁধার সময় লোহার আংটিও পরানো হয়। আবার মারাঠাদের বিয়ের সময় ঢাল-তরবারি সঙ্গে নেওয়ার রেওয়াজ আছে।
এদেশের লিঙ্গায়েত সম্প্রদায়ের মধ্যে সংস্কার আছে, তাঁদের কারো মৃত্যু হলে শেষকৃত্যের শেষে তাঁর সমাধিস্থলের ওপর একটি ধারালো কুড়ুল ও একটি কোদাল রেখে তার ওপর গুরুদেবকে দাঁড় করানো হয়। এর পর গুরুদেবের পায়ে জল ঢালা হয়। বলা হয়, এতে মৃত ব্যক্তির আত্মা অশুভ হতে পারে না। এছাড়া লিঙ্গায়েত সম্প্রদায়ের মেয়েদের মধ্যে গর্ভবতী হওয়ার সময় থেকেই তার মাথার চুলে একটি লোহার ছু়ঁচ ব্যবহারের সংস্কার আছে। আবার দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন স্থানে সদ্য প্রসূতির বিছানার প্রতিটি কোণে একটি করে পেরেক পুঁতে দেওয়া হয়।শুধু আমাদের দেশ ভারতবর্ষেই নয়, পাশ্চাত্য দেশেও লোহা ব্যবহারে সংস্কার আছে। যেমন, ১৩৫০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে উল্কাপাতের লোহা থেকে তৈরি একটি সারকোফেগাস (Sarcophagus) রক্ষাকবচ হিসেবে মিশর সম্রাট তুতানখামেনের পিরামিডের গম্বুজের ওপর লাগানো হয়েছিল। আবার রোমান ঐতিহাসিক প্লিনির লেখা থেকে জানা যায়, দুষ্ট আত্মার হাত থেকে রেহাই পেতে সে দেশের লোকজন শবাধারের লোহা থেকে তৈরি পেরেক দরজা-জানালার ওপরে লাগানো থাকতো।
এছাড়াও দেশে দেশে লোহার ব্যবহার আছে। যেমন, চিনে ড্রাগনের হাত থেকে রেহাই পেতে লোহার ব্যবহার আছে। ইংল্যাণ্ডের বহু বাড়ির বাইরে প্যাঁচানো লোহার বন্ধনী লাগানো হয় অগ্নিভয় নিবারণের জন্য। এছাড়াও ইংল্যাণ্ডে বাড়িতে লোহার তৈরি ঘোড়ার পায়ের ক্ষুর ঝুলিয়ে রাখার সংস্কার আছে। বলা হয়, এর ফলে ঘরে অশুভ আত্মার আগমন ঘটে না।
আসলে লোহার আবিষ্কার কৃষিতে বিপ্লব এনেছিল। কাঠের লাঙলের বদলে লোহার লাঙল ব্যবহার করে জমিতে উদ্বৃত্ত ফসল ফলেছিল। স্বাচ্ছন্দ্য এসেছিল মানুষের জীবনে। তাই লোহা হয়ে যায় পবিত্র এবং অশুভ বিনাশকারী। এর ফলে লোহাকে ঘিরে জন্ম নেয় বিভিন্ন সংস্কারের। আর এখনও লোহাকে ঘিরে বহু সংস্কার বর্তমান রয়েছে।
তথ্যসূত্র :
1) Man and his Superstition : Carveth Read.
2) All about Superstitions : Dr. Girija Khanna and Harimohan Khanna.