সনাতন সৌঃ
বীরভূমের তন্ত্র সাধনায় অন্যতম পীঠস্থান হলো মহাতীর্থ তারাপীঠ। এখানে আছেন জগৎ বিখ্যাত তারামায়ের মন্দির ও মহাসাধক বামাক্ষেপার তন্ত্র সাধনাক্ষেত্র। এছাড়া রয়েছে মহাশ্মশান। জানা গিয়েছে যে, ১২৭৪ বঙ্গাব্দে সাধক বামাক্ষেপা তারাপীঠের মহাশ্মশানে শ্বেতমুল বৃক্ষের তলায় সিদ্ধলাভ করেছিলেন। তারামায়ের ও সাধক বামাক্ষেপার মাহাত্ম্যর কথা দেশজুড়ে বিখ্যাত হয়েছে। মানুষের অগাধ বিশ্বাস অনুযায়ী, তারাপীঠে কৌশিকী অমবস্যা তিথিতে তারা মায়ের বিশেষ পুজোয় অংশগ্রহণ করে দ্বারকা নদীতে স্নান করলেই জীবনের সব পাপ মুক্তি মেলে। তাই কৌশিকী অমবস্যায় দেশ-বিদেশ থেকে বহু পুণ্যার্থীরা তারাপীঠে ছুটে আসেন। এই পূণ্য দিনে মহাশ্মশানে স্নান করে বহু ভক্ত নরনারী তারা মায়ের পুজো দেন। এই কৌশিকী অমাবস্যা প্রসঙ্গে কিছু মাহাত্ম্য কথা তুলে ধরছি। কথিত রয়েছে, মূখ্যচান্দ্র শ্রাবণ গৌণভাদ্র কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যা তিথির নামই হলো কৌশিকী অমাবস্যা। ২৭ ভাদ্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ইঃ ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ বৃহস্পতিবার কৌশিকী অমাবস্যা তিথি। তাই এই দিনের বিশেষ তিথির দিবা রাত অনুষ্ঠিত হচ্ছে জগত মাতা শ্রীশ্রী কালিকা দেবী কৌশিকী রূপে ধরাধামে তাঁর সকল ভক্ত গণের দ্বারা মহাধুম ধামের সাথে তারা মায়ের আরাধনা।
অবশ্য বহুকাল পূর্বথেকেই বৎসরে এই একটি দিনের দিবাগত রাতে তারাপীঠেও মহা ধুমধাম সহকারেই জগত মাতা শ্রীশ্রী তারা দেবীরও বিশেষ পূজা অর্চনা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। শুধু তাই নয় এই দিনের দিবাগত রাতে মায়ের আরাধনা কিন্তু অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে বীরভূমের তারাপীঠ মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয়। তাছাড়া এই কৌশিকী অমাবস্যা তিথির রাতে জগত মাতা শ্রীশ্রী তারা দেবীর আরাধনার বিহিত সময় নির্ঘন্ট খুব নিষ্ঠার সাথে মেনে চলে আসছে কিন্তু পরম্পরা থেকে। তার একমাত্র কারণ হলো পুরান অনুযায়ী মহাপরাক্রমশালী অত্যাচারী শম্ভু ও নিশম্ভু নামক অসুর ভ্রাতৃদ্বয়কে বধের নিমিত্তে মহাদেবী শ্রীশ্রী পার্বতী স্নান সমাপনান্তে স্বীয় দেহের কোষ কলা রূপান্তর করে উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণা দেবী অর্থাৎ কৌশিকী কালিকা রূপে আবির্ভূতা হলেন। তিনি ছিলেন আযোনী সম্ভবা।
এই কৌশিকী অমাবস্যার ঘোরতমসা আবৃত নিশীথে দেবী কৌশিকী শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামক অসুর ভ্রাতৃদ্বয়কে বধ করে দেবালোকে পুনঃরায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছিলেন। আপনাদের সকলের অবগতির নিমিত্তেই আমি এখন জানাবো এই কৌশিকী অমাবস্যা তিথিটিকে ঘিরে আসলেই পৌরাণিক আরও কোন কোন কাহিনী এখনো প্রচলিত রয়েছে। তাছাড়াও কেনই বা আবার এই অমাবস্যা তিথিটির নাম হয়েছে কৌশিকী অমাবস্যা তিথি?
আমাদের সনাতন হিন্দু ধর্মের পুরাণ শাস্ত্র গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, প্রচন্ড প্রতাপের অসুর শুম্ভ ও নিশুম্ভ ভাতৃদ্বয়। কোন এক সময়ে তারা উভয়ে সন্মিলিত ভাবে পরমেশ্বর ভগবান প্রজাপতি শ্রীশ্রী ব্রহ্মা দেবকে তুষ্ট করার জন্য একে বারে কঠিনতর সাধনা আরম্ভ করে দিয়ে ছিলেন। তাদের সাধনায় পরমেশ্বর প্রজাপতি শ্রীশ্রী ব্রহ্মাদেব তুষ্ট হওয়ার পর তিনি তাদেরকে তাদের সাধনোচিত বরটি প্রার্থনা করতে বললেন! তখন তাদেরকে প্রার্থনাচিত বর দিতে গিয়ে ব্রহ্মা দেব তাদের উভয়কে এই মর্মে বর দেন যে, তাদের এই ভাতৃদ্বয়কে কখনো কোনও পুরুষ লোক হত্যা করতে পারবেন না! কেবল মাত্র তাদের মৃত্যু হতে পারে! একমাত্র সেই নারীর হাতেই, যিনি মাতৃগর্ভ থেকে এখনো সমগ্র বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে কোথাও জাত হননি। এমন দেববাণী শ্রুত হওয়ার পরই শুম্ভ নিশুম্ভ মহানন্দে স্বর্গ ধামের দেবতাদের উপর অত্যাচারের মাত্রা পূর্বের তুলনায় আরো অনেক বহুগুণ বাড়িয়ে দিল।
পরমেশ্বর প্রজাপতি শ্রীশ্রী ব্রহ্মা দেবের কাছ থেকে বর পাওয়ার পর শুম্ভ ও নিশুম্ভর এমন পৈশাচিক তান্ডবের কারণে দেবভূমি প্রকম্পিত হতে লাগলো। দেবতা গণ স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর তাঁরা তাঁদের হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার করার জন্য স্বর্গস্থ সকল দেবতাগণই যখন এই অসুর ভ্রাতাদ্বয়কে বিনাশের কথা ভাবতে লাগলেন, ঠিক তখনই তাঁদের অক্ষিপটে ভেসে এল ভগবতী শ্রীশ্রী পার্বতী দেবীর নামটি। যিনি দক্ষরাজের শিব বিহিন দক্ষ যজ্ঞস্থানে আত্মাহুতি দেওয়ার ফলে কৃষ্ণবর্ণ রূপ ধারণ করেছিলেন। অতঃপর এই কৃষ্ণবর্ণা দেবীই কিন্তু কঠিন যজ্ঞের পর আবার কালিকা দেবী রূপে অবতীর্ণ হয়েও ছিলেন। তাঁর দেহের কোশিকা অর্থাৎ তাঁর দেহের কোষ বিভাজন কালো বর্ণ হওয়ার কারণেই কিন্তু তাঁর নামটি হয়েছিল কৌশিকী। আর এই তিথিতে তিনি মহাশক্তির অধিকারিনী হয়ে এই কৌশিকী রূপেই বধ করে ছিলেন শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামক ভয়ানক অসুর ভ্রাতৃ দ্বয়কে।
এই বিষয়ের উপর ভিত্তি করে আমাদের পুরাণ শাস্ত্র গ্রন্থ গুলোর মধ্যে অন্যতম মৎসপুরাণ এবং মাণ্ডেয় পুরাণেও অপর একটি কাহিনীও কিন্তু বর্ণিত রয়েছে। আবার ঐ কাহিনীটির মধ্যে বলা হয়েছে, এই অসুর ভ্রাতৃদ্বয় শুম্ভ ও নিশুম্ভকে বধ করতে দেবী শ্রীশ্রী পার্বতীও পরমেশ্বর প্রজাপতি ব্রহ্মা দেবের কঠিন সাধনা আরম্ভ করে দিয়ে ছিলেন। সেই তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করার পর তিনি তাঁর নিজের দেহের সেই শ্বেতশুভ্র রঙটিকে আবার পরিত্যাগ করে ফেলেছিলেন। অতঃপর তিনি কিন্তু আবার উজ্জ্বল কালো বর্ণের একটি ভয়াল রূপও ধারণও করে ছিলেন। সেই রূপেই দেবী পার্বতীই হয়ে ওঠে ছিলেন “কৌশিকী” নামে পরিগণিতা। আসলে কিন্তু এই কৌশিকী অমাবস্যা তিথির নিশিরাতের এক বিশেষ কালক্ষণের অন্ধকারেই তিনি বধ করেছিলেন ঐ শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামের দুই অসুর ভ্রাতাকে। শুম্ভ ও নিশুম্ভ বধের সেই কালক্ষণকেই স্মরণ করে অনুষ্ঠিত হয় আসলে কৌশিকী অমাবস্যা তিথিতে রাতভর মায়ের এই বিশেষ ধরনের পূজার্চনা।
কেবলমাত্র সনাতন হিন্দু ধর্ম শাস্ত্রের মতাদর্শ অনুযায়ীই যে শুধুমাত্র কৌশিকী অমাবস্যা তিথির নিশিরাতে এই আদ্যাশক্তি মহামায়ার আরাধনা করা হয়ে থাকে সেটিও কিন্তু নয়! বৌদ্ধধর্ম মতেও মহাতন্ত্র সাধনার নিমিত্তে এই দিনটি তাদের ধর্মের সবৎসাধকদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের শাস্ত্রজ্ঞ গণের অভিমত কৌশিকী অমাবস্যার রাতে ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক শক্তিকেই একত্রে সাধনা করার মাধ্যমে সকল তান্ত্রিক গণই ধারণ করে থাকেন। এই সাধনা করার ফলেই কিন্তু আসলে আশাতীত ফল লাভ করতে পুরোপুরি ভাবে সক্ষম হয়ে থাকেন তন্ত্রসাধকগণ। এই মহাপূর্ণ্য তিথিতে তারাপীঠের মহাশ্মশানে এই তন্ত্রসাধনার কর্ম সফলভাবে সম্পাদন করা হয়ে থাকে। তাই দূর দূরান্ত থেকে বহু পুণ্যার্থীরা তারাপীঠে ছুটে আসেন তারা মায়ের আশীর্বাদ পেতে।