ধনতেরশ

সোমদত্তা চ্যাটার্জীঃ

দেখতে দেখতে চলে এলো উৎসবের মরশুম। শরৎকালের শারদীয়া উৎসব। যদিও‌ এবার মলমাসের চক্করে শারদীয়া উৎসব শরৎকালে হচ্ছে না। শুরুই হচ্ছে হেমন্তে। অবশেষে আমাদের সারা বছরের অপেক্ষার অবসান। শুরু হবে একের পর এক পুজো। প্রথমেই আসবেন ‘মা দুর্গা’। তারপরে তাঁর বড় কন্যা ‘মা লক্ষ্মী’। শেষে আসবেন ‘মা কালী’। তো এই সব পুজোর মাঝেই বেশ ক’বছর ধরে ঢুকে পড়েছে এক নতুন উৎসব – ধনতেরশ। অর্থাৎ কিনা ধন-ত্রয়োদশী। দুর্গা পুজোর পরের অমাবস্যা তে হয় কালী পুজো। তার আগের দিন হলো ভুত-চতুর্দশী। আর তার ঠিক আগের দিন হচ্ছে ধন-ত্রয়োদশী। সমস্ত নামজাদা সোনার দোকানে এই সময়ে দেয় বেশ কিছুটা ছাড়। তাই এই সময়ে কিন্তু গয়নাগাটি কেনার বেশ একটা হিড়িক পড়ে যায়। অনেকেই মনে করছেন এটা হুজুকে বাঙালীর জীবনের নবতম হুজুক। এর পিছনে আছে বড়-বড় ব্যবসাদারদের মাথা। যা আমাদের দামী ধাতু কিনতে করছে বাধ্য।

 তা কথাটা নেহাৎ মিথ্যেও নয়। আজ থেকে মাত্র দশক দুই আগেও কিন্তু সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালী পরিবারে ধনতেরশে গয়না কেনার ধুম তো দূরের কথা, চলন-ই ছিল না। তখন ধনতেরশের নামই জানতো না কেউ‌। ধনতেরশে ধাতু কেনার বিষয়টা প্রথম মলি মাসীর কাছে শুনেছিলাম আমি। তা প্রায় দশক দুই আগের কথা। ওর আসানসোলে বিয়ে হয়েছে। ওখানে প্রচুর অবাঙালীর বাস। শুনেছিলাম – ঐ বিশেষ দিনে অবাঙালীরা নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু না কিছু ধাতব দ্রব্য কিনে থাকেন। তা ওই ‘শোনা’তে-ই বিষয়টা থেমে ছিল। তখন দেশব্যাপী বিস্তৃত গয়নার দোকানের চেন আমাদের মফস্বল শহর সিউড়ি তে শাখা খোলেনি। ধনতেরশে সোনা-রুপোয় ছাড়ের গপ্প এখানে কেউ গায়নি। আর তাই আমরা মানে আম আদমিও সোনাদানা কিনতে ছুটিনি। এখন কিন্তু টুকটাক কিছু না কিছু কিনি সবাই। অর্থাৎ কিনা লাভবান হচ্ছেন সেই ব্যবসায়ীকূল।

এখন হয়েছে কী – গত বেশ ক’বছর ধরে ধনতেরশের ঠিক আগে-আগে ফেসবুকে দেখা যাচ্ছে এক বিশেষ ধরনের পোস্ট। যার বিষয়বস্তু হল — ধনতেরশের সঙ্গে ‘ধন’-এর কোনো সম্পর্কই নেই, দেব-বৈদ্য ধন্বন্তরীর সঙ্গেই হলো আদত সম্পর্ক। এটা দেখে কেমন যেন একটু ধন্ধ লাগলো। একী রে বাবা! ধন আর ধন্বন্তরী তে গুলিয়ে ফেলল বেবাক দেশসুদ্ধু লোক! এ যে আলু আর আলুবোখারা কে এক করে দেওয়া! তাই কী কখনো হয়!? অতএব শুরু হলো ধনতেরশ নিয়ে ধন্ধ নিরসনের প্রক্রিয়া। অন্তর্জালের দুনিয়ায় এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি। যা জানলাম তা এক সুষ্ঠ জীবনের কথা। যেখানে ধন এবং ধন্বন্তরী — দুই-ই সমান প্রাসঙ্গিক।

ধনতেরশের দিন কেবলমাত্র দামী দ্রব্য কেনা-ই নয়, অনেক কিছুই অবশ্য কর্তব্য। এমন multitasking ব্যাপার কিন্তু আর কোনো তিথিতে নেই বললেই চলে। প্রথমেই হচ্ছে কেনাকাটার কথা। এদিন ধাতব মুদ্রা ও বাসন-কোসন কেনা খুব ভালো বলে প্রচলিত। আসল কথা হল সঞ্চয়। এসব নিয়ম যখন কার, তখন তো আর ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা ছিল না। উপার্জিত অর্থ সঞ্চয়ের জন্য দামী ধাতব মুদ্রা কেনা-ই সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত হিসেবে গণ্য হত। এদিন গয়না কেনার কথা কিন্তু কোথাও পড়িনি। এখন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থাও পাল্টে গেছে। সঞ্চয়ের হরেক উপায় হয়েছে। তাই ধনতেরশের কেনাকাটায় এখন সঞ্চয়ের জায়গায় প্রাধান্য পাচ্ছে শৌখিনতা। বেড়ে উঠছে হরেক রকম গয়না কেনার চলন।

জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে উৎসব এবং ঈশ্বরের আরাধনা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে কোনো একজন দেব বা দেবীর পূজো নয়। এই তিথিতে একাধিক দেব দেবীর পূজো করাই বিধেয়।

প্রথম কর্তব্য হলো মৃত্যুলোকের অধিপতি যমরাজের উদ্দেশ্যে দীপদান। একটি বড় মাটির প্রদীপে প্রচুর পরিমাণে সর্ষের তেল দিয়ে এই প্রদীপ জ্বালাতে হবে, যাতে সারা রাত্তির প্রদীপটি জ্বলতে পারে। ভিতরে দিতে হবে ফুটো কড়ি। জীবনের ধন কিছুই ফেলনা নয়। ফুটো কড়িটিও জরুরী। তার একটা সম্মান প্রাপ্য। তাই তারও যত্ন নিতে হবে। এই জ্বলন্ত প্রদীপ কে কেন্দ্র করেই নিবেদিত হবে যমরাজের উদ্দেশ্যে পুজো। তারপর প্রদীপটি সদর দরজার বাইরে দক্ষিণমুখী ভাবে রেখে দিতে হবে। এমনিতে প্রদীপ কিন্তু সবসময়ই উত্তর বা পূর্ব মুখে জ্বালানোই রীতি। যমরাজ যাতে সহজে চিনে নিতে পারেন, সেজন্যই বোধহয় এক্ষেত্রে ঘটে ব্যতিক্রম। এই পুজোর প্রার্থনাটি বড় সুন্দর। এই পুজোর মাধ্যমে যমের কাছে অনন্ত জীবন কামনা করা হয় না। কামনা করা হয়  অকালমৃত্যু রোধ। মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, তাকে মানতেই হবে। তবে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কারো যেন অকালে মৃত্যু না ঘটে। তাই এই বিশেষ পুজো।

অকাল মৃত্যু রোধের চেষ্টার পরেই শুরু হয় সুস্থ-নীরোগ জীবনের প্রার্থনা। অকাল মৃত্যু আটকানোর জন্যে চাই যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা। তাই এদিনের দ্বিতীয় পর্যায়ের আরাধ্য হলেন দেববৈদ্য ধন্বন্তরী। কেবলমাত্র নির্দিষ্ট পদ্ধতি তে ধন্বন্তরীর পুজো করলেই চলবে না, ১০৮ বার মন্ত্র জপ করাটাও আবশ্যিক। এসব পুজো-পাশা করতে কিছু খরচ-খরচা তো থাকবেই। আর সবার পক্ষে তা সম্ভব-ও নয়। তাহলে যাঁদের এসব করার সামর্থ্য নেই, তাঁদের কী হবে? ধন্বন্তরীর কৃপা থেকে কি তাঁরা বঞ্চিত হবেন?! না মোটেই না, সে বিষয়টিও ধর্তব্যের মধ্যেই ধরা আছে। তাই সামর্থ্য সম্পন্ন মানুষদের ঔষধপত্র দান করার বিধান দেওয়া হয়েছে। গরীব মানুষদের অর্থদান নয়, নির্দিষ্ট করে ঔষধপত্র দানের কথাই বলা আছে। কে না জানে, অর্থ হাতে থাকলেই নানাবিধ খাতে খরচ হয়ে যায়। আর উৎসবের মরসুমে ওষুধপত্র কেনার জন্যে কে আর খরচ বরাদ্দ করে!? তাহলে? এমতাবস্থায় কোনো অঘটন‌ ঘটলে, তার চিকিৎসার ব্যবস্থা কী করে হবে? তাই জন্যেই বোধ হয় নির্দিষ্ট করে ঔষদ দানের বিধি। এই দানের উপরেই নির্ভর করে দেববৈদ্যের পুজোর সাফল্য। এভাবেই উৎসবের মধ্যেও যথাযথ ভাবে গুরুত্ব পায় সুস্বাস্থ্য।

তৃতীয় পর্যায়ে রয়েছে মাতা লক্ষী ও গণপতির আরাধনা। মনে করা হয় মাতা লক্ষ্মী এই দিনে মর্ত্যে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাই ধনতেরশের দিন লক্ষী-গণপতির নতুন মূর্তি বাড়িতে আনাই নিয়ম। এদিনের পুজো ঠিক ষোড়শোপচারের পুজো নয়। ছোট করে পঞ্চোপচারে পুজো। একে বরং welcome ritual বলাই ঠিক হবে। বড় করে পুজো তো হয় দীপাবলির দিন। আমাদের উপার্জনের দেখভাল করেন এই দুই ভাই বোন। উপার্জন না থাকলে তো জীবন-ই চলতে চাইবে না। তাই সুস্থ ও সুষ্ঠ জীবনে বাঁচার জন্য লক্ষ্মী-গণপতির সন্তুষ্টি বিধান অবশ্য কর্তব্য।

উপার্জন তো নিশ্চিত হলো। কিন্তু উপার্জিত অর্থ উড়িয়ে-পুড়িয়ে উচ্ছন্নে দিলে তো চলবে না। যথাযথ ভাবে সঞ্চয় তো করতে হবে‌। তাই, এর পরেই আসে সঞ্চয়ের চিন্তা। এদিনের শেষ পর্যায়ে পুজো পান সঞ্চয়ের দেবতা কুবের। অনেকেই লক্ষী-গণপতির সাথে সাথেই নতুন কুবেরের মূর্তিও বাড়ি নিয়ে আসেন। আর বাড়ি তে ধাতব বা পাথরের মূর্তি থাকলে তো কোনো কথাই নেই। তখন আর কোনো দেব-দেবীর মূর্তিই বারংবার কেনার দরকার পড়ে না। বিশেষ পুজোর আগে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে নতুন ভাবে সাজসজ্জা করে নিলেই চলে। ধনতেরশে কেনা ধাতব মুদ্রা পুজোর সময় কুবের দেব কে অর্পণ করে তুলে রাখাই রীতি। ভীষণ রকম বিপদ-আপদে না পড়লে, এই মুদ্রা কেউ খরচ করেন না। অন্তত একটা বছর রেখে দেওয়াই ভাল। যে কোনো কারণেই হোক কুবেরের আরাধনার প্রচলন এখন আর বাঙালীদের মধ্যে নেই বললেই চলে। বাঙালী উদ্যোগপতির দেখা এখন‌ আর মেলে না। নির্দিষ্ট মাইনের চাকরী‌ খোঁজার মধ্যেই তাদের যাবতীয় উদ্যোগ সীমাবদ্ধ। আর তাই, বাঙালীর সঞ্চয়ের ভাণ্ডার এখন এতই সীমিত, যে, তা সামলানোর ভার কুবের দেব কে দেওয়া টা-ই অবশ্য লজ্জাজনক।   তো, এই হল ধনতেরশের ‘টোটাল প্যাকেজ’। পালন করা বা না-করা, যার যার নিজস্ব ব্যাপার। তবে আমার কিন্তু গোটা বিষয়টা বেশ ভালোই লেগেছে আর বটেও রীতিমত আকর্ষণীয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *