যজ্ঞ দ্বারা যুক্ত ধরা

সোমদত্তা চ্যাটার্জীঃ

এবার ১লা বৈশাখ আশ্রমে, বিল্বমঙ্গল ধামে গেছিলাম। বাবাজী আর মা কে প্রণাম জানিয়ে শুরু করেছি নতুন বছরের পথ চলা। মায়ের তখন নবরাত্রির ব্রত চলছিল। তাই মা মৌন ছিলেন। কথাবার্তায় জমিয়ে রেখেছিলেন বাবাজী। সেদিনই বাবাজী বলেন – ইলামবাজারে দীপক হাজরা বাবুদের ব্যবস্থাপনায় ‘মা মনসা দেবী’-র মন্দিরের দারোদ্ঘাটনের উৎসবের কথা। তার সঙ্গে নির্দিষ্ট পরিমানে যব, কৃষ্ণতিল, ঘি আর ঢেলা কর্পূর যজ্ঞে আহুতি দেবার জন্যেও করেন আহ্বান। তারপরে তো বাড়ি ফিরে এলাম। মা গ্রুপে ঐ উৎসবের আমন্ত্রণ পত্রের ছবি পোস্ট করলেন। আর আমরাও নির্দিষ্ট জিনিসপত্র জোগাড় করে যাবার জন্য প্রস্তুতি শুরু করে দিলাম।
২৩শে এপ্রিল, মঙ্গলবার বিকেলে বাড়ি থেকে রওনা দিলাম। ইলামবাজার মোড়ে পৌছতেই নজরে পড়লো মায়ের ছবি দেওয়া হোর্ডিং। তার একটু পরেই দেখতে পেলাম বাবাজীর ছবি। নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছেও মনে যেন একটা কিন্তু-কিন্তু ভাব। আসলে আমাদের তো সাধারণ গেরস্তের মধ্যবিত্ত মন। তাই অচেনা জায়গায় ঢুকতে একটু ইতস্তত বোধ। রাস্তার ধারে চেনা কাউকে দেখতেও পাচ্ছি না।
যাই হোক গুটিগুটি পায়ে ঢুকেই পড়লাম বাড়ির ভেতর। ‘মা মনসা দেবী’-র মন্দিরের কাছে পৌছতেই দেখি সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের পরম নিশ্চিন্ততার আশ্রয় বাবাজী। আমাদের দেখেই বাবাজী জানতে চাইলেন – সব জিনিসপত্র ঠিকঠাক এনেছো তো মা? আমরা সবকিছু নিয়ে গেছি জেনে আস্বস্ত হলেন বাবাজী। ‘মা মনসা দেবী’ ও বাবাজী কে প্রণাম জানিয়ে আমরাও হলাম নিশ্চিন্ত।
পৌছনো মাত্রই জলযোগের ব্যবস্থা ছিল। এই গরমের মধ্যে জলপানের মতো স্বস্তি তো আর কিছুতেই নেই। দীপক বাবুরা জলের ব্যবস্থা রেখেছিলেন পর্যাপ্ত। গাছের তলায় বসে চারিদিকে দেখছি। শুরু হয়ে গেছে যজ্ঞের ব্যবস্থাপনা। তা কত্তে-কত্তেই সব ভক্তবৃন্দ এসে জড়ো হয়েছেন। সবার কাছেই তাদের নিজেদের আহুতি দ্রব্য। চেনা মানুষজনদের সঙ্গে দেখা হয়ে ভাল লাগল। শুরু হলো নিজেদের মধ্যে কুশল বিনিময়। পুজোপার্বণ তো এই ভাবেই একের সঙ্গে অপরের যোগসূত্র তৈরী করে।


এবার বাবাজীর তত্ত্বাবধানে শুরু হলো আহুতি দ্রব্য মিশ্রনের কাজ। একটা বড় জায়গায় সবার আনা যব, কৃষ্ণতিল, ঘি আর কর্পূর মেশানো হলো। তার সঙ্গে মেশানো হলো আরো নানান দ্রব্য। এবার আমাদের দেয়া হলোএকটা করে বড় মাটির মালসা তে সেই মিশ্রণ। যজ্ঞ শুরু হলে এই মালসা থেকে মিশ্রণ নিয়েই আহুতি দিতে হবে। সবাই সেই মালসা কোলে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
একটু পরেই সমবেত উলুধ্বনি ও ঢাকবাদ্যের সহযোগে উপস্থিত হলেন শ্রী শ্রী ১০৮ মা আরাধ্যা গিরিজী, মানে আমাদের মা। এসে যজ্ঞকুণ্ডের সামনে দাঁড়ালেন। মন্দিরের ‘মা মনসা দেবী’ কে প্রণাম জানালেন। মালা হাতে শুরু করলেন জপ। আমরাও জপ করলাম আপন আপন ঈষ্টমন্ত্র। মায়েদের মনে সাধন-ভজনের সঙ্গেই সমান ভাবে থাকে সন্তানদের চিন্তা। আমাদের মা-ও তার ব্যতিক্রম নন। মা নিজের আসনে উপবিষ্ট হয়েই চারিপাশে লক্ষ্য করতে শুরু করলেন। আমরা, যারা একটু দূরে বসেছিলাম, তাদের ডেকে নিকটে বসালেন। আমি এমন সুন্দর বসার জায়গা পেলাম – সামনেই যজ্ঞাগ্নির ভেতর দিয়ে সরাসরি মন্দিরে দেবীর দর্শন পাচ্ছিলাম।


এইবার বাজনা-বাদ্যি সহযোগে উপস্থিত হলেন শ্রী শ্রী ১০০৮ সোহম বাবাজী। বিকেলের বেশভূষা পরিবর্তন করে এখন যজ্ঞের জন্য প্রস্তুত বাবাজী। প্রথমে কিছু জরুরী কথা বললেন – ভক্ত-শিষ্যদের সময়ানুবর্তী ও নিয়মানুবর্তী হবার প্রয়োজনীয়তা বোঝালেন। যজ্ঞকুণ্ড থেকে নিরাপদ দূরত্বে ভক্ত-শিষ্যদের সরিয়ে বসালেন। তারপরে প্রত্যেকের আহুতি যথাযথ ভাবে যজ্ঞাগ্নি তে নিক্ষেপ করার জন্য করলেন শালপাতার ব্যবস্থা। এইখানে ছোট্ট করে একটু শালপাতার ব্যবস্থার বিষয়ে বলে নিই, যাঁরা উপস্থিত ছিলেন না, তাঁদের বুঝতে সুবিধে হবে। প্রত্যেকের হাতে একটি করে শালপাতার থালা দেয়া হলো। যজ্ঞকুণ্ড থেকে নিরাপদ দূরত্বে বসে, মন্ত্রোচ্চারণের সময় প্রত্যেক ‘স্বাহা’ ধ্বনি তে আহুতি প্রদান কিঞ্চিত অসুবিধাজনক বটে। এছাড়াও আহুতি দ্রব্য সরাসরি যজ্ঞাগ্নি তে নিক্ষিপ্ত না হয়ে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে যাবার সম্ভাবনাও রয়েছে। তাই প্রত্যেক ‘স্বাহা’ ধ্বনি তে আহুতি দ্রব্য শালপাতায় জমা করতে হবে। বেশ কিছুটা জমা হয়ে গেলে, তখন উঠে যজ্ঞাগ্নি তে করতে হবে অর্পণ।
সন্ধ্যা অতিক্রান্ত হয়ে এলে শুরু হলো যজ্ঞ, ‘রুদ্র যজ্ঞ’। প্রথমেই বাবাজী ‘রুদ্রদেব’ কে যজ্ঞস্থলে আবির্ভুত হতে জানালেন সনির্বন্ধ অনুরোধ। তারপরে আরাধ্যা মা কে সঙ্গে নিয়ে যজ্ঞকুণ্ড প্রদক্ষিণান্তে করলেন অগ্নি সংযোগ। শুরু হলো অবিচ্ছিন্ন মন্ত্রোচ্চারণ। বাবাজী, মা এবং পুরোহিতদের একক বা সম্মিলিত মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যেই চলতে থাকলো আমাদের আহুতি প্রদান।
নির্দিষ্ট আহুতি দ্রব্য তো ছিলই, এর সঙ্গে বাবাজী আমাদের হাতে আহুতি দেবার জন্যে কখনো বেলপাতা, কখনো পদ্মফুল, কখনো বা গোটা ফল দিয়েছিলেন। আমরাও বাবাজীর নির্দেশ মতো করেছিলাম আহুতি প্রদান।
যজ্ঞ চলাকালীন গায়ে এক-দু ফোঁটা জল পড়েছিল ঠিক-ই, তবে যজ্ঞ সম্পূর্ণ হওয়া মাত্রই শুরু হলো স্বস্তির বৃষ্টি। বৃষ্টি রূপে যেন আমাদের মাথায় ঝরে পড়লো ‘রুদ্রদেব’ এবং ‘জগন্মাতা’-র আশীর্বাদ। কতদিন পরে যে বৃষ্টি হলো! বৃষ্টির মধ্যেই বাবাজী করলেন আরতি। সেদিনের মতো সম্পূর্ণ হলো পূজা।


পুজোর শেষে মায়ের হাত থেকে নিলাম চরণামৃত। অপূর্ব তার স্বাদ। মা জানালেন – বাইরে খাবার জায়গায় ভাণ্ডারা চালু হয়ে গেছে। আমরা সবাই যেন অন্ন প্রসাদ গ্রহণ করি।
সেদিনের অন্ন প্রসাদও খুব ভালো লেগেছে। সেখানেও পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার জলের ব্যবস্থা ছিল। আর সবথেকে যেটা ভালো লেগেছে – তা হলো দীপক বাবুদের পরিবারের সদস্যদের ব্যবহার। এত আন্তরিক ছিল তাঁদের ব্যবহার, আমরা যে ব্যক্তিগত ভাবে পূর্ব পরিচিত নই – তা মোটেই মনে হচ্ছিল না।
সবশেষে যখন বাড়ি ফিরছি, মনে এক অদ্ভুত আনন্দের রেশ। সে আনন্দ ভাষায় বোঝানো যায় না। চারিদিক নিস্তব্ধ। বহুদিন পরে বৃষ্টি তে শীতল হয়েছে ধরিত্রী। বাহিরে-অন্তরে বিরাজ করছে পরম স্বস্তি। ‘জগন্মাতা’-র কাছে প্রার্থনা করি – তিনি তাঁর সন্তান – তাবৎ জীবকূল কে এমন ভাবেই আনন্দে রাখুন।
জয় ‘মা’ জয় ‘মা’ জয় জয় ‘মা’।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *