নয়াপ্রজন্ম প্রতিবেদনঃ
২০০৯ সালের ১৫ই জানুয়ারি, নিউইয়র্ক শহরের এক শীতল দুপুরে ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে যায় একটি অবিশ্বাস্য ও সাহসিকতায় পূর্ণ ঘটনা—যা আজ ‘Miracle on the Hudson’ নামে পরিচিত। এই কাহিনীর কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন ক্যাপ্টেন চেসলি “সালি” সালেনবার্গার (Captain Chesley “Sully” Sullenberger)। তাঁর ধীর, স্থির বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষ নাবিকসুলভ সিদ্ধান্ত একসাথে ১৫৫ জনের প্রাণ বাঁচায়।

ঘটনার পটভূমি
US Airways Flight 1549, একটি Airbus A320, নিউ ইয়র্কের LaGuardia বিমানবন্দর থেকে Charlotte, North Carolina-এর উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। বিমানে মোট ১৫৫ জন ছিলেন, যার মধ্যে ১৫০ জন যাত্রী এবং ৫ জন ক্রু মেম্বার।
মাত্র ৩ মিনিট পর, বিমানটি ২,৮০০ ফুট উচ্চতায় পৌঁছানোর সময় এক দল কানাডিয়ান বন্য রাজহাঁস (Canadian Geese) বিমানের সঙ্গে ধাক্কা খায়। এই পাখির সংঘর্ষের ফলে বিমানের উভয় ইঞ্জিন সম্পূর্ণভাবে অকেজো হয়ে পড়ে।

জরুরি অবস্থা ও সিদ্ধান্ত
ইঞ্জিন বিকল হওয়ার পর ক্যাপ্টেন সালি ও সহ-পাইলট জেফ স্কাইলস রেডিওতে ‘Mayday’ সংকেত পাঠান। তারা কাছাকাছি LaGuardia বিমানবন্দর, Teterboro Airport -এ জরুরি অবতরণের বিকল্প খোঁজেন। তবে খুব কম উচ্চতা, গতি, এবং সময়ের অভাবে কোনটিই নিরাপদ বিকল্প ছিল না।
এই পরিস্থিতিতে ক্যাপ্টেন সালি একটি সাহসী সিদ্ধান্ত নেন—হাডসন নদীতে জরুরি জল অবতরণ।

হাডসন নদীতে অবতরণ
মাত্র ২১৩ সেকেন্ড সময়ের মধ্যে সালি সম্পূর্ণ ইঞ্জিনবিহীন বিমানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে হাডসন নদীতে সুনিপুণভাবে অবতরণ করান। এটি ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক একটি ‘ditching’—অর্থাৎ জলে বাধ্যতামূলক অবতরণ।
বিমানটি ভেঙে না গিয়ে জলের ওপরে ভেসে থাকে। যাত্রীরা জানালা ও দরজার মাধ্যমে বের হয়ে উইংয়ের ওপর উঠে পড়েন। কাছাকাছি ফেরি ও উদ্ধারকারী দল দ্রুত এসে যাত্রীদের উদ্ধার করে। আশ্চর্যজনকভাবে, কেউ প্রাণ হারায়নি—মাত্র কয়েকজনের সামান্য আঘাত লেগেছিল।

প্রশংসা ও স্বীকৃতি
এই ঘটনাকে বলা হয় “Miracle on the Hudson”। ক্যাপ্টেন সালি রাতারাতি জাতীয় নায়কে পরিণত হন। তাঁর সিদ্ধান্ত, শান্ত মাথায় দ্রুত বিশ্লেষণ এবং জীবনরক্ষাকারী দক্ষতার জন্য তাঁকে বহু পুরস্কার ও সম্মাননা দেওয়া হয়। মার্কিন কংগ্রেসের পক্ষ থেকেও তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানানো হয়।
পরবর্তীতে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৈরি হয় একটি হলিউড চলচ্চিত্র—“Sully” (2016), যেখানে টম হ্যাঙ্কস অভিনয় করেন ক্যাপ্টেন সালি’র ভূমিকায়। এই সিনেমাটি সারা বিশ্বে ব্যাপক প্রশংসা পায়।

তদন্ত ও প্রভাব
NTSB (National Transportation Safety Board) এই ঘটনার বিস্তারিত তদন্ত করে। তারা দেখতে পায়, যদি সালি বিমানবন্দরে ফিরে আসতে চেষ্টা করতেন, তাহলে সেটি একটি মারাত্মক দুর্ঘটনায় রূপ নিতে পারত। তাঁর সিদ্ধান্ত ছিল একমাত্র সঠিক সিদ্ধান্ত।
এই ঘটনার পরে পাখি-সংঘর্ষ প্রতিরোধে মার্কিন বিমানবন্দরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়।
ক্যাপ্টেন সালি’র এই ঘটনা শুধুমাত্র একটি সফল জল-অবতরণ নয়, বরং একটি জীবনের পাঠ—কি ভাবে ধৈর্য, অভিজ্ঞতা, মানবিকতা ও নেতৃত্ব হাজারো প্রাণ বাঁচাতে পারে। এটি এক অনন্য উদাহরণ যা প্রমাণ করে, সঠিক সিদ্ধান্ত সময়ে নিলে অলৌকিক ঘটনাও বাস্তবে সম্ভব হতে পারে।