ফরাক্কা-গঙ্গা জলবণ্টন চুক্তির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত? ভারতের জল সরবরাহ সীমিতকরণের বার্তা বাংলাদেশকে

নয়াপ্রজন্ম প্রতিবেদনঃ

ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের এক গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ফরাক্কা-গঙ্গা জলবণ্টন চুক্তি। গঙ্গা নদী দুই দেশের জন্যই এক গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ এবং জীবনরেখা। তাই এই নদীর জল বণ্টন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বহুদিন ধরেই আলোচনা ও মতবিরোধ চলছিল। অবশেষে ১৯৯৬ সালে একটি স্থায়ী সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হয়, যা আজও দুই দেশের মধ্যে জলসম্পদ নিয়ে সমঝোতার ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত।

গঙ্গা নদী ও এর গুরুত্ব

গঙ্গা নদী ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের গোমুখ হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয়ে উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে পদ্মা নদী নামে পরিচিত হয়। এই নদী শুধু ভারতের নয়, বাংলাদেশের কৃষি, পরিবেশ এবং মানুষের জীবনধারার সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িত। কিন্তু শীতকালে বা শুকনো মরসুম ফারাক্কা ব্যারাজের কারণে গঙ্গার জলপ্রবাহ অনেকটাই কমে যায়, যার ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে জলসংকট দেখা দেয়।

ফারাক্কা ব্যারাজ

চুক্তির পটভূমি

১৯৭৫ সালে ভারত ফারাক্কা ব্যারাজ চালু করে, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল হুগলি নদীর জলে পলি সঞ্চয় হ্রাস করা ও কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বজায় রাখা। কিন্তু এতে বাংলাদেশের নদীগুলিতে জলপ্রবাহ কমে যাওয়ায় পরিবেশগত ও কৃষিকাজে মারাত্মক প্রভাব পড়ে।

দীর্ঘ আলোচনার পর, ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এইচ. ডি. দেবগৌড়া এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন, যার মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে গঙ্গার জল বণ্টন নিয়ে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়।

চুক্তির মূল বিষয়বস্তু

  • চুক্তির মেয়াদ ৩০ বছর (১৯৯৬-২০২৬)।
  • জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত গঙ্গার জলের পরিমাণ ১০ দিনের ভিত্তিতে পরিমাপ করে দুই দেশের মধ্যে বণ্টন করা হবে।
  • যদি জলের পরিমাণ ৭০,০০০ কিউসেকের নিচে নেমে আসে, তাহলে দুই দেশ সমানভাবে জল পাবে।
  • জলপ্রবাহ নিরীক্ষণের জন্য একটি যৌথ প্রযুক্তিগত কমিটি (Joint Rivers Commission) গঠন করা হয়েছে, যা বছরে একাধিকবার বৈঠক করে তথ্য আদান-প্রদান করে।

সাম্প্রতিক উত্তেজনা ও ভারতের হুঁশিয়ারি

গত কয়েক বছরে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপে পড়েছে। কিছু আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের অবস্থান ও কিছু প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা নিয়ে ভারত উদ্বিগ্ন হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ও কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে যে, ভারত সরকার সতর্কবার্তা দিয়েছে—বাংলাদেশ যদি ভারতের স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপ অব্যাহত রাখে, তবে ফারাক্কা ব্যারাজ থেকে সরবরাহকৃত জল সীমিত করা হতে পারে বা জলের প্রবাহে বিধিনিষেধ আরোপ করা হতে পারে

যদিও এই সিদ্ধান্ত এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয়নি, তবে এমন সম্ভাবনা দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের আস্থার সম্পর্ককে প্রভাবিত করতে পারে। কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই সংকেত ভবিষ্যতে আরও জটিল পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারে, যদি উভয় পক্ষ আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে না পৌঁছায়।

ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ

  • বাংলাদেশে প্রাপ্য জল অনেক সময়ে কম পাওয়া যাচ্ছে বলে অভিযোগ।
  • ভারতের অভ্যন্তরেও জলসংকটের চাপ বাড়ছে।
  • জলবায়ু পরিবর্তন গঙ্গার উৎস ও প্রবাহকে অনিশ্চিত করে তুলছে।
  • ২০২৬ সালে চুক্তির মেয়াদ শেষ হতে চলেছে—তাই তার আগেই একটি নবায়ন বা নতুন চুক্তির খসড়া প্রস্তুত করা অত্যন্ত জরুরি।

ফরাক্কা-গঙ্গা জলবণ্টন চুক্তি ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি শুধু একটি চুক্তি নয়, বরং দুই দেশের পারস্পরিক আস্থা, কূটনৈতিক দক্ষতা এবং পরিবেশ সংবেদনশীলতার প্রতিফলন। তবে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং জল নিয়ে কূটনৈতিক চাপ ভবিষ্যতের জন্য এক গুরুতর ইঙ্গিত। এই সংকট সমাধানে দুই দেশের উচিত দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে একে অপরের স্বার্থ ও আস্থাকে গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে চলা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *