অক্সাই চিন: ইতিহাস, প্রাচীন রাজ্য ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কিত ভূ-রাজনৈতিক বিতর্ক

নয়াপ্রজন্ম প্রতিবেদনঃ

অক্সাই চিন (Aksai Chin) হল হিমালয়ের উত্তরের একটি বিস্তীর্ণ উচ্চ মালভূমি অঞ্চল, যা আজ চীনের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ভারত একে নিজের অখণ্ড ভূখণ্ডের অংশ বলে দাবি করে। এটি শুধু আধুনিক কূটনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু নয়, বরং প্রাচীন যুগের ইতিহাস, বাণিজ্যপথ এবং সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের এক গুরুত্বপূর্ণ এলাকা।

ভৌগলিক অবস্থান

অক্সাই চিন প্রায় ৩৮,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত, যার বেশিরভাগ অংশই শুষ্ক ও উঁচু মালভূমি। এটি ভারতের লাদাখ অঞ্চলের অংশ হিসাবে বিবেচিত হলেও বর্তমানে চীনের শিনজিয়াং ও তিব্বত স্বশাসিত অঞ্চল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

প্রাচীন রাজ্য ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

১. কুষাণ সাম্রাজ্য (১ম ৩য় শতক)

অক্সাই চিন অঞ্চল কুষাণ সাম্রাজ্যের বিস্তারভূক্ত ছিল বলে ইতিহাসবিদরা মনে করেন। এই সাম্রাজ্য ভারত, আফগানিস্তান ও চীনের কিছু অংশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারের জন্য কুষাণ শাসক কনিষ্ক বিশেষভাবে স্মরণীয়। এই অঞ্চল ছিল বৌদ্ধধর্মের তীর্থযাত্রী ও সিল্ক রোডের পথিকদের যাত্রাপথের অংশ।

২. গুপ্ত সাম্রাজ্য ও পরবর্তী যুগ

গুপ্ত যুগে (৪র্থ–৬ষ্ঠ শতক) ভারতের উত্তরাঞ্চল বৌদ্ধ ও হিন্দু সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল কেন্দ্র হয়ে ওঠে। অক্সাই চিন ছিল এই সাংস্কৃতিক প্রভাবের বাইরের এক প্রান্তে, তবে এই অঞ্চলের বাণিজ্যপথ ও অভিযাত্রীদের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

৩. তিব্বতী সাম্রাজ্য (৭ম৯ম শতক)

তিব্বতী রাজা Songtsen Gampo-র শাসনামলে তিব্বতী সাম্রাজ্য অনেক উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে বিস্তার লাভ করে। অক্সাই চিন অঞ্চল তিব্বতের বাণিজ্যপথ ও কৌশলগত এলাকার অন্তর্গত হয়, এবং এখান থেকে তিব্বত ও মধ্য এশিয়ার মধ্যে আদানপ্রদান হত।

৪. লাদাখের নামগিয়াল রাজবংশ (১৫শ১৯শ শতক)

লাদাখের স্বাধীন রাজ্য ও নামগিয়াল বংশের শাসকেরা এই অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। তারা তিব্বতের সঙ্গে যুদ্ধ এবং সন্ধির মাধ্যমে সীমান্ত স্থির করার চেষ্টা করেছিল। লেহ থেকে ইয়ারকান্দ পর্যন্ত ব্যবসায়ী পথের একটি অংশ ছিল অক্সাই চিন অঞ্চল।

৫. ডোগরা অভিযান (১৮৩৪১৮৪১)

জম্মুর মহারাজা গুলাব সিং-এর সেনাপতি জোরাবার সিং এই অঞ্চল সহ গোটা লাদাখ ও পশ্চিম তিব্বত দখল করেন। এতে ভারতের আধুনিক রাজনৈতিক মানচিত্রে অক্সাই চিনের অন্তর্ভুক্তি ঘটে। এই সময় থেকেই ভারতীয় আধিপত্যের প্রাথমিক ভিত্তি তৈরি হয়।

ঔপনিবেশিক সীমারেখা ও বিতর্ক

  • জনসন লাইন (1865): ব্রিটিশ সার্ভেয়ার উইলিয়াম জনসন লাইন অঙ্কন করেন, যা অক্সাই চিনকে জম্মু-কাশ্মীরের অংশ হিসেবে দেখায়। ভারত এই লাইন অনুসরণ করে।
  • ম্যাকডোনাল্ড লাইন (1899): ব্রিটিশরা চীনের সঙ্গে আপসের ভিত্তিতে একটি নতুন সীমা প্রস্তাব করেছিল, যা অক্সাই চিনকে চীনের অন্তর্গত হিসেবে দেখায়। চীন তখন কোনও প্রতিক্রিয়া জানায়নি।

আধুনিক ভারতের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান

১৯৪৭ সালের পর ভারত অক্সাই চিনকে তার সীমার মধ্যে ধরে নেয়।

১৯৫০-এর দশকে চীন গোপনে একটি রাস্তা নির্মাণ করে, যা ১৯৫৭ সালে জনসমক্ষে আসে — G219 হাইওয়ে (শিনজিয়াংতিব্বত)।

১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধএর প্রধান কারণ ছিল অক্সাই চিন নিয়ে বিরোধ। চীন সেই যুদ্ধের পর থেকে অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে।

আজকের পরিস্থিতি

  • ভারত এখনও অক্সাই চিনকে নিজের অংশ বলে মনে করে এবং ভারতীয় মানচিত্রে এটি অন্তর্ভুক্ত।
  • চীন এই অঞ্চলকে সামরিক, প্রশাসনিক এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত করেছে।
  • গালওয়ান সংঘর্ষ (২০২০)-এর সময় এই বিতর্ক আবার আন্তর্জাতিক আলোচনায় উঠে আসে।

অক্সাই চিন কেবল আধুনিক সীমান্ত বিরোধের প্রতীক নয়, এটি ভারতের প্রাচীন ইতিহাস, সাংস্কৃতিক প্রভাব এবং কৌশলগত অবস্থানের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কুষাণ ও লাদাখি শাসকদের আমলে এই অঞ্চল ছিল সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক মেলবন্ধনের সেতুবন্ধন। আজও এই অঞ্চল ভারতের ভূখণ্ডগত অখণ্ডতার প্রশ্নে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে বিবেচিত হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *