মলুটি গ্রাম: ইতিহাস, ঐতিহ্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব

নয়াপ্রজন্ম প্রতিবেদনঃ

মলুটি, ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দুমকা জেলার শিকারিপাড়া ব্লকের অন্তর্গত একটি ঐতিহাসিক গ্রাম। একে “মন্দির নগরী” হিসেবেও অভিহিত করা হয়। প্রায় ৭২টি প্রাচীন মন্দির নিয়ে এই গ্রাম একদিকে যেমন ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই প্রত্নতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এক অনন্য ধনভাণ্ডার।

বাজ বসন্ত রাজবংশ ও মালুটির উত্থান

১৫শ শতকে এই গ্রামটি “নঙ্কর রাজ্যের” রাজধানী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ইতিহাস অনুযায়ী, গৌড়ের সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ (১৪৯৫–১৫২৫ খ্রিঃ) কাটিগ্রামের এক দরিদ্র ব্রাহ্মণপুত্র বসন্ত রায়কে একটি বাজ (শিকারি পাখি) ফিরিয়ে দেওয়ার পুরস্কারস্বরূপ এই করমুক্ত রাজ্য দান করেন। এই ঘটনার পর থেকেই তিনি ‘বাজ বসন্ত রায়’ নামে পরিচিত হন। শুরুতে রাজধানী ছিল দামরায়, পরে তা স্থানান্তরিত হয়ে মালুটিতে আসে।

বসন্ত রায়ের এই উত্থানের পেছনে ছিল সুমেরু মঠের দণ্ডিসন্যাসীর আশীর্বাদ। তখন থেকেই বারাণসীর সুমেরু মঠের প্রধান, যিনি রাজগুরু নামে পরিচিত, বাজ বসন্ত রায়ের বংশধরদের আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক হয়ে আসছেন। আজও রাজগুরু প্রতিবছর মালুটিতে কিছুদিন অবস্থান করেন।

কেন মলুটি হল মন্দির নগরী?

বাজ বসন্ত রাজবংশের রাজারা প্রাসাদ নির্মাণের পরিবর্তে মন্দির নির্মাণে আগ্রহী ছিলেন। রাজবংশটি একাধিক ‘তারাফে’ বিভক্ত হয়ে যায়, এবং প্রতিটি তারাফ অন্যকে ছাপিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় মন্দির নির্মাণে ব্রতী হয়। এই প্রতিযোগিতার ফলস্বরূপ মালুটি হয়ে ওঠে এক অনন্য মন্দির গ্রাম। মন্দিরগুলির অলঙ্করণে হিন্দু পুরাণের নানা দৃশ্য, যেমন রামায়ণ ও মহাভারতের চিত্র ফুটে উঠেছে। প্রায় সব মন্দিরেই প্রাচীন প্রোটো-বাংলা লিপিতে লেখা রয়েছে, যার বেশিরভাগ মন্দিরের নামই নারীদের নামে।

প্রাচীন ইতিহাস ও গৌরব

মলুটি, যা “গুপ্ত কাশী” নামেও পরিচিত ছিল, শুধুমাত্র মধ্যযুগের রাজত্বকালেই নয়, বরং প্রাচীন যুগেও এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাকেন্দ্র ছিল। শুঙ্গ বংশের (১৮৫ খ্রিঃপূঃ – ৭৫ খ্রিঃপূঃ) আমলেও এই স্থানের উল্লেখ পাওয়া যায়। পালিপুত্রের রাজা এখানে অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন বলেও জনশ্রুতি আছে। বৌদ্ধদের বজ্রযান শাখার তান্ত্রিক অনুসারীরাও এখানে বসতি গড়ে তোলে। এখানেই প্রতিষ্ঠিত হয় মা মৌলীক্ষা, যিনি এই অঞ্চলের প্রধান আরাধ্য দেবী।

এই দেবী মা মৌলীক্ষা হিন্দু শাস্ত্রে না থাকলেও, তাঁকে বজ্রযান বৌদ্ধধর্মে পাণ্ডোরারূপে উল্লেখ করা হয়েছে। পরবর্তীকালে হিন্দু তন্ত্র মতে তাঁকে পূজা করা হয়। আজও মলুটি মায়ের মন্দির এই গ্রামের প্রধান কেন্দ্র।

স্বামী বামদেবের আগমন

১৮৫৭ সালের আশেপাশে বিখ্যাত সাধক বামাক্ষ্যাপা মলুটিতে পুরোহিত হতে আসেন, কিন্তু সংস্কৃত মন্ত্র মুখস্থ করতে না পারায় তাঁকে পূজার রান্নার দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রায় ১৮ মাস তিনি মলুটিতে অবস্থান করেন এবং মা মৌলীক্ষার মন্দিরেই প্রথম সিদ্ধিলাভ করেন। পরে তিনি তারাপীঠে চলে যান। তাঁর ত্রিশূল আজও মলুটিতে সংরক্ষিত।

নামের উৎপত্তি ও ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট

কিছু ইতিহাসবিদ মনে করেন, মলুটি নামটি ‘মল্লহাটি’ শব্দের পরিবর্তিত রূপ, যা বাংলার বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজাদের প্রভাবাধীন ছিল। এই অঞ্চল তখন ‘দামিন-ই-কোহ’ নামে পরিচিত ছিল, যার অন্তর্ভুক্ত ছিল বর্তমান পাকুড়, বর্ধমান, মেদিনীপুর এবং ছোটনাগপুর মালভূমির কিছু অংশ। তাই “মল্লভূম”-এর সাথে মিল রেখে এই নামের উৎপত্তি হয়ে থাকতে পারে।

প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব ও প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শন

মলুটির পাশ দিয়ে প্রবাহিত চিলা নদীর তীরে পাওয়া গেছে প্রাগৈতিহাসিক পাথরের সরঞ্জাম। এই নদী ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গের সীমানা চিহ্নিত করে। নদীর উৎস বান্সপাহাড়ি এবং তা মিশে যায় দ্বারকা নদীতে। এখানে পাওয়া যন্ত্রপাতি যেমন হ্যান্ড-অ্যাক্স, স্ক্র্যাপার, ব্লেড ইত্যাদি প্রাচীন প্যালিওলিথিক যুগের নিদর্শন।

বিশ্বভারতীর প্রত্নতত্ত্ববিদ অধ্যাপক সুব্রত চক্রবর্তী এই সরঞ্জামগুলিকে ‘আশুলিয়ান’ ও ‘মধ্য প্যালিওলিথিক’ শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। এখান থেকে মেসোলিথিক যুগের কিছু নিদর্শনও পাওয়া গেছে। চিলা নদীর সদরঘাট থেকে শিরালী পর্যন্ত এক কিলোমিটার এলাকায় এই নিদর্শনগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।

বর্তমান অবস্থা ও সংরক্ষণের সংকট

এক সময় বাজ বসন্ত রাজবংশ ১০৮টি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন বলে জানা যায়। বর্তমানে তার মধ্যে মাত্র ৭২টি মন্দিরই দাঁড়িয়ে আছে, বাকিগুলি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ভেঙে পড়েছে। ২০১০ সালে “Global Heritage Fund”-এর একটি রিপোর্টে মলুটির মন্দিরগুলিকে বিশ্বের ১২টি বিপন্ন ঐতিহাসিক স্থানের তালিকায় রাখা হয়।

মন্দিরগুলোর স্থাপত্যে নির্দিষ্ট কোনো একধরনের শৈলী (যেমন নাগর, বেসার বা দ্রাবিড়) অনুসরণ করা হয়নি। বরং বাংলার দেশীয় কারিগররা তাদের সৃজনশীলতা দিয়ে পাঁচটি ভিন্নধর্মী ডিজাইন ধারায় মন্দিরগুলিকে অলংকৃত করেছেন।

মলুটি শুধুই একটি গ্রাম নয়, এটি এক ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের ধারক। এখানকার প্রাচীন মন্দিরসমূহ, প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শন ও তান্ত্রিক উপাসনার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে এই গ্রাম আজও বিস্ময় জাগায়। সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর উচিত মলুটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই সমৃদ্ধ ইতিহাস থেকে বঞ্চিত না হয়।

নয়াপ্রজন্ম ডিজিটাল-এ আমরা শুধুমাত্র প্রবন্ধই নয়, ভ্রমণ ভ্লগের মাধ্যমে রোড ম্যাপ ও বিস্তারিত তথ্যসহ ভিডিওও আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। আমাদের ভিডিওটি দেখুন, সাবস্ক্রাইব করুন এবং একটি লাইক দিন, যাতে আমরা ভবিষ্যতেও এরকম আরও তথ্যসমৃদ্ধ প্রবন্ধ ও ভিডিও আপনাদের জন্য নিয়ে আসতে পারি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *