বীরভূমের শূক্রাবাদে ওডিশা ফেরত ১৯ পরিযায়ী: নাগরিক না অনুপ্রবেশকারী? সন্দেহ, রাজনীতি ও পরিচয়ের লড়াইয়ে বিধ্বস্ত

নয়াপ্রজন্ম প্রতিবেদনঃ

বীরভূম জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম শূক্রাবাদ। এখানকার ১৯ জন পরিযায়ী শ্রমিক গত ২৫ জুন ওডিশার বালাসোরে ‘অবৈধ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ সন্দেহে গ্রেফতার হন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে উঠেছে তীব্র বিতর্ক—এই শ্রমিকরা কি ভারতের বৈধ নাগরিক, নাকি বাস্তবেই অনুপ্রবেশকারী? পুলিশ ও স্থানীয়দের বক্তব্যে দেখা যাচ্ছে দুই বিপরীত চিত্র।

পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন

ধৃতদের মধ্যে অধিকাংশই স্ক্র্যাপ ব্যবসায়ী, অ্যালুমিনিয়াম ব্যবসায়ী ও দিনমজুর। তাঁরা সকলেই বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম পুরুষ, যাঁরা দীর্ঘদিন ধরেই ঋতুভিত্তিক শ্রমের জন্য ওডিশায় যাতায়াত করতেন।

৩৮ বছরের সাইদুর রহমান জানান,
পুলিশ আমাদের থানায় ডেকে ডকুমেন্ট চেক করে। আধার কার্ড ও ফোন কেড়ে নিয়ে বলে আমরা বাংলাদেশি। এরপর আমাদের ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়।

নয়দিন ধরে তাঁরা পরিবার বা আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি। ৪৭ বছরের নাসিম আখতার বলেন,
আমার স্ত্রী ভেবেছিল আমি মারা গেছি। আমরা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিলাম।

আবদুল হাদি নামের এক ব্যবসায়ী বলেন,
আমার লাইসেন্স ও পরিচয়পত্র ছিল। কেউ ভালো করে দেখেনি। শুধু দেখে নিল ভাষা, ধর্ম ও নাম।

পুলিশের বক্তব্য

ওডিশা পুলিশ অবশ্য বলছে, ধৃতদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের কাগজপত্রে অসঙ্গতি রয়েছে। নাম, ঠিকানা, জন্মতারিখ—সবই সন্দেহজনক। এক পুলিশ আধিকারিক নাম না করে জানান, আমরা কিছু পরিচয়পত্র সরকারি ডাটাবেসে খুঁজে পাইনি। তাই সন্দেহ তৈরি হয়। তদন্ত চলেছে, বৈধতা প্রমাণ হলে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হবে।

তাঁদের মতে, অনুপ্রবেশের সম্ভাবনা রুখতে সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। বাংলা ভাষাভাষী হলেই কেউ বাংলাদেশি নয়—এ কথা যেমন মান্য, তেমনি সন্দেহজনক কাগজপত্র নিয়ে তদন্ত করাও পুলিশের কর্তব্য।

শূক্রাবাদের হাল

ঘটনার পর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে শূক্রাবাদ গ্রামে। তখন সামনে আসেন মোহাম্মদ মহসিন মণ্ডল, গ্রামের প্রাক্তন পঞ্চায়েত সভাপতি।
ওঁরা ভোটার, ট্যাক্স দেন, কাজ করেন। কাউকে না কাউকে তো কথা বলতেই হত। আমি মন্ত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, আবেদন জমা দিয়েছি,” বলেন মহসিন।

তাঁর প্রচেষ্টায় প্রশাসনিক স্তরে হস্তক্ষেপ হয়, আইনি সহায়তা পৌঁছায়, এবং শেষ পর্যন্ত ধৃত শ্রমিকদের মুক্তি মেলে।

ভারতে নাগরিকত্বের প্রমাণ বলতে এখন যে শুধুমাত্র আধার বা ভোটার কার্ডই যথেষ্ট নয়, তা স্পষ্ট। একইসঙ্গে, প্রশাসনের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে—ভুয়ো নথি নিয়ে ঘুরে বেড়ানো অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করাও গুরুত্বপূর্ণ।

এত সবের মাঝে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ পরিশ্রমী মানুষ, যাঁরা শুধুমাত্র রুটি-রুজির জন্য রাজ্য ছেড়ে পাড়ি দেন ভিনরাজ্যে।

এই ঘটনার মাধ্যমে উঠে এসেছে এক দ্বিমুখী বাস্তবতা—যেখানে প্রশাসনের নিরাপত্তা ও সচেতনতা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই মানুষের মৌলিক অধিকার ও সম্মান রক্ষাও জরুরি। শূক্রাবাদের ১৯ জন মানুষ আজ মুক্ত, কিন্তু তাঁদের অভিজ্ঞতা থেকে জাতীয় স্তরে বৃহত্তর আলোচনা হওয়া দরকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *