তীর্থ কুমার পৈতণ্ডী
দুদফায় টানা বারোদিনের সিনেমা সুটিং শেষ করে ফিরে গেল পিপা টিম। প্রথমদফায় ১৬ থেকে ২০ নভেম্বর আর দ্বিতীয় দফায় ১৫ থেকে ২১ ডিসেম্বর পিপা সিনেমার সুটিং আসর বসেছিল মহঃবাজার থানার চরিচা গ্রাম পঞ্চায়েতের ঝাড়খণ্ড সীমান্তের বৈদ্যনাথপুর গ্রামে। তিনদিকে ঝাড়খণ্ড রাজ্য ঘেরা রাজপুত প্রধান গ্রাম বৈদ্যনাথপুরের একদিকে যেমন ছোটনাগপুর মালভূমির উঁচুনীচু টিলা। দূরে ম্যাসাঞ্জোড়ের পাহাড় শ্রেণি, অন্যদিকে ভয়ংকরী প্রাণচঞ্চলা ময়ূরাক্ষী। একপাশে আদিগন্ত সবুজ-হলুদ পাকা ধান তো অন্যপাশে চরিচার ঘন শাল জঙ্গল। বিশাল বিশাল ডাঙা, বয়ে চলা ঝুমরি কাঁদর আর সোনাঝুরি জঙ্গলের ভেতর দিয়ে কদমহীড় আদিবাসীপল্লী মুখে চলে যাওয়া লাল মোরাম রাস্তা। হেথা হোথা তালগাছের সারি, ছোট ছোট ঝোপজঙ্গল আর শিশুগাছের উঠতি বনাঞ্চল। গল্পের সঙ্গে এমন মানানসই জায়গা আর কোথায়! পিপা টিম তাই তাদের গল্পের সুটিং করার জন্য বেছে নিয়েছে এই গ্রামকে। ১৯৭১ সালের ভারত-পাক যুদ্ধ নির্ভর এই সিনেমার পরিচালক রাজকৃষ্ণ মেনন। প্রযোজক রাজকাপুর ফিলিম্স। গল্পের নায়ক ব্রিগেডিয়ার বলরামসিং মেহেতা। ব্রিগেডিয়ারের চরিত্রে অভিনয় করছেন বোম্বের উঠতি নায়ক ইশান খট্টর। নভেম্বরের গোড়া থেকেই গ্রামে হৈ হৈ কাণ্ড, রৈ রৈ রব। ভাঙা রাস্তায় মোরাম পড়লো। প্রাথমিক বিদ্যালয় জুড়ে বিশাল প্যাণ্ডেল। সামনে পিছনে ডাঙা জুড়ে ছোট বড় আরও কত রঙীন প্যাণ্ডেল। অন্ধকার রাস্তা যেন দিনের থেকেও আলোময়। আলোর বন্যা। সুটিং স্পটে একাধিক যুদ্ধট্যাঙ্ক, অস্হায়ী শিবির, সারি সারি চালাঘর। জড়ো করা হয়েছে বস্তা বস্তা ঘুঁটে। এখানে ওখানে খড়ের গাদা। সোনাঝুরি জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া মোরাম রাস্তার উপর পোতা হল অস্হায়ী গাছ। ছড়ানো হল শুকনো পাতা। দেখে বোঝার উপায় নেই এখানেই ছিল বৈদ্যনাথপুর কদমহীড় গাড়ি চলাচলের রাস্তা। সাজো সাজো রব পূর্ণতা পেল ১৫ নভেম্বর।এল ছোট বড় কয়েকশো গাড়ি, এল অ্যাম্বুলেন্স, দমকল, স্বাস্হকর্মীদের দল এবং সুটিং পার্টি। সতীতলা জুড়ে বিশাল খাবর ঘর। রান্নায় ব্যস্ত ঠাকুর, চাকর। এল গাড়ি গাড়ি খাবর। কি তার চোখ ধাঁধানো আয়োজন। এল আর্মি, পুলিশ, সিভিক, অস্হায়ী হাসপাতাল আরও কত কি। শুরু হল সুটিং। বন্ধ হল রাস্তা। নোএন্ট্রি। মানুষ, গাড়ি তো দূরের কথা, একটা মাছি যাবারও অনুমতি নাই। হাজার হাজার দর্শক শুধু গাড়ি ও জাকজমক দেখে ফিরে যায়। শুধু কানে আসে বোম আর গুলির শব্দ। শুরু হয় যুদ্ধের সুটিং। বোমা ফাটে, যুদ্ধ ট্যাঙ্ক এগিয়ে চলে, চালাঘরে আগুন জ্বলে, এখানে ওখানে ঘুঁটে পোড়ার ধোয়া। জ্বলছে খড়ের গাদা। সত্যি যেন যুদ্ধক্ষেত্র। একপাশে ভারতীয় সৈন্য অন্যপাশে শত্রু দল। জঙ্গল থেকে ছুটে আসে বন্দুকধারী সৈন্য। ফাটে বোমা। আগুনের লাল গোলা গ্রাস করে যুদ্ধক্ষেত্র। লুটিয়ে পড়ে সৈন্যরা। ভোর রাত্রি থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে সুটিং। নায়ককে এক পলক চোখে দেখার জন্য তার গাড়ি ঘিরে ভিড় উৎসুক জনতার। তেড়ে আসে পুলিশ। অবশেষে সদয় হয় নায়ক। গাড়ির উপর দাঁড়িয়ে দেখা দেয় ভক্তদের। আপ্লুত জনতা। চোখের সামনে স্বপ্নের নায়ক। পাঁচদিনের সুটিং শেষ। ‘হেথা নয়, হেথা নয় অন্য কোথা অন্য কোন খানে’। পিপা টিম চলে গেল বোলপুর দুর্গাপুর। ফিরতি পথে কয়েকদিনের সুটিং হবে আবার এখানে মনে পড়ে পুরনো কথা। ১৯৭৮ সাল। পাশের গ্রাম নৌরঙ্গীধামে চলছিল তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘গণদেবতা’ সিনেমার সুটিং। পরিচালক তরুণ মজুমদার। এসেছিল সেকালের বিখ্যাত এক ডজনেরও বেশি অভিনেতা যারা বাংলা সিনেমার উজ্জ্বল নক্ষত্র। ক্যামেরার চারপাশে বসে সুটিং দেখেছি। চোখের সামনে স্বপ্নের নায়ক সৌমিত্র, দেবরাজ, অজিতেষ, সন্ধ্যা, তরুণ আরও কত। কি মধুর তাদের ব্যবহার। কথা বলতেন গ্রামের মানুষের সঙ্গে। ছিল না পুলিশের কড়াকড়ি। যাক সে কথা। পিপা বদলে ছিল নভেম্বরের পরিবেশ। কাজ পেয়েছে গ্রামের ছেলেরা, পয়সা পেয়েছে ক্ষতিগ্রস্থ জমির মালিকরা। এল ডিসেম্বর। ভিন জায়গায় সুটিং শেষ করে পিপা টিম আবার ফিরে এল বৈদ্যনাথপুরে। ১৫ থেকে ২১ ডিসেম্বর আবার টানা সুটিং। না, এবার আর গোলাগুলি নয় এবার অন্য সুটিং। স্কুল খুলে গেছে তাই তাবুর জায়গা পরিবর্তন হল। শিশুগাছের জঙ্গল জুড়ে তৈরী হল সারি সারি অসংখ্য আর্মি ব্যারাক। ক্রেন দিয়ে আকাশে উঠলো জোরালো আলো। সেই আলোয় চলে দুপুর থেকে গভীর চাই পর্যন্ত সুটিং। মা বোনেদের উপর অত্যাচার, রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে পূর্ব পাকিস্থান থেকে ভারতে পালিয়ে আসা, অত্যাচারিত বাংলা ভাষীদের জীবন যন্ত্রনা এসবই ছিল দ্বিতীয় দফায় সুটিং কথায়। ১৯৭১ সালের মুক্তি যুদ্ধের পিপা সিনেমার সুটিং চলছে যে বৈদ্যনাথপুর গ্রামে সেই গ্রামের তিন সৈনিক সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন ৭১-এর বাস্তব যুদ্ধে। সেই তিনজনের দুজন এখনো জীবিত। ১৯৬২ সালে চিন-ভারত যুদ্ধের পরই ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোদগান করেন স্বর্গীয় শান্তিকুমার পৈতণ্ডী, অম্বিকাচরণ সিংহ এবং ভবশংকর সিংহ। মুক্তিযুদ্ধে ভারত অংশগ্রহণ করলে ভারতীয় সেনারা ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকবাহিনীর উপর। সাঁড়াশি আক্রমণে বিদ্ধস্হ পাকবাহিনী। এ সময় অম্বিকাকাকা ছিলেন কলকাতায় আর ভবশংকর কাকা ছিলেন পূর্বপাকিস্হানের পিপা গ্রামে, যে গ্রামে পাকবাহিনী হাজার হাজার নারীর উপর অত্যাচার চালিয়েছিল। হত্যা করেছিল শিশু আর বৃদ্ধদের। এই সময় আমার বাবা ছিল আগরতলায়। সেনাবাহিনীর উপর বোমা ফেলেছিল পাকিস্থান। খবর এল, কেউ আর বেঁচে নেই। ঘরে কান্নার রোল। কান্না কান্না আর কান্না। কোন যোগাযোগ নাই, চিঠিপত্র নাই। অন্য দুজনও কোন সঠিক উত্তর দিতে পারলো না। বাবা ঘর এল তিন মাস পর, জীবিত, অক্ষত। যখন আগরতলায় বোম পড়ে সেনাবাহিনী তখন মাটির নীচে গর্তের ব্যারেকে। পাকবাহিনী একদিন আত্মসমর্পণ করে। সেনাবাহিনী বীরের সম্মান পায়। সেই ভারত-পাক যুদ্ধ নির্ভর গল্প ‘পিপা’র সুটিং হল তাদেরই গ্রামে পঞ্চাশ বছর পর, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তীবর্ষে আর আমাদের স্বাধীনতার পঁচাত্তোরতম বর্ষে। গর্বিত আমরাও।