
ড. আদিত্য মুখোপাধ্যায়ঃ
প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো, লোকশিল্পীরা আগের মতো অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের বিপন্নতার কাল এখন অতিক্রম করে এসেছে। এখন তারা প্রত্যেকে সরকারি কার্ড পেয়েছে, প্রতি অনুষ্ঠানে এক হাজার করে টাকা পাচ্ছে, ষাট বছর বয়স হলেই ভাতা পাচ্ছে। বিনেপয়সায় বাড়ি, রেশন সব পাচ্ছে। সরকারের এ এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। ফলে অনেকটাই ভালো আছে লোক শিল্পীরা। যদিও বেনোজলও ঢুকেছে লোকশিল্পীদের তালিকায়। তা ঢুকলেও আসল শিল্পীতো বাদ যাচ্ছে না কোনোকিছু থেকেই। লোকপুরের সেরপাই শিল্প এখন টিকে আছে মাত্র কার্তিকের জামাই ভোলানাথের পরিবারে। সেরপাই তৈরিও হচ্ছে খুব কম। তাতেই দিল্লি থেকে এক লক্ষ টাকার পুরস্কার সম্প্রতি নিয়ে এলো ভোলানাথের স্ত্রী রুমা কর্মকার। বাইশের ডিসেম্বর মাসের আঠারো এবং উনিশ তারিখ, দুদিন ধরে হাজার আঠেক শিষ্ট দর্শকের সামনে মঞ্চে লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন আঙ্গিক প্রদর্শিত হল রামনগর-সাহোড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের অঙ্গনে। এইসময়ের অন্যতম সেরা রায়বেঁশে শিল্পী বাসুদেব ভল্লা এবং তার যুবগোষ্ঠী ছিল এই অনুষ্ঠানের আয়োজক। তাদের নিজেদের জুনিয়র দলটি মূলত মেয়েদের দল, তারা সেদিন যে খেলা দেখালো তা অতুলনীয়। তাছাড়াও ছিল দাসকলগ্রামের অধীর মণ্ডলের আলকাপ, ধনডাঙার কার্তিক দাসের আবেগাকুল বাউল গান, জগন্নাথপুরের আদিবাসী নৃত্য, রসরাজ মণ্ডল-দেবাশিস মণ্ডল-সুকান্ত মণ্ডল-পার্থসারথি দেবনাথের কবিগান, ভাদুগান, বোলান গান, একপাহাড়িয়ার আব্দুল হাসিব সাহেব ও কুড়ি জন সঙ্গীর গাওয়া অনবদ্য জারিগান, কান্দির দেবপর্ণা গোস্বামীর যোগনৃত্য ছিল বাড়তি পাওনা। দ্বিতীয় দিন রাতে ছিল পুরুলিয়ার ছো-নাচ। মঞ্চ কখনো ফাঁকা থাকেনি। ঝর্নাধারার মতো বাউলগান, ফকিরিগান, বহুরূপী সবই চলেছে। চারশো ছিয়ানব্বই জন লোকশিল্পী অংশগ্রহণ করেছিল এই উৎসবে। সারা বাংলাতেই, বলা যায় ভারতবর্ষেই, এত বড়ো লোকসংস্কৃতির উৎসব অসরকারি ভাবে আর কোথাও হয়েছে বলে আমার জানা নেই। দুশো ছিচল্লিশটি ঢাক ঢোলের সঙ্গে বহুরূপী রণপা সহযোগে গ্রামবদলের শোভাযাত্রাও অপূর্ব। আসলে এই অনুষ্ঠানে প্রাচীন লোকগানের ভাঁড়ার খুলে ধরেন শিল্পীরা। শ্রোতারাও মুগ্ধ হয়ে শোনেন দুর্লভ সেই গান, দেখেন লোকনাট্য। রামনগর সাহোড়ার অচঞ্চল শ্রোতা-দর্শকদেরও ধন্যবাদ প্রাপ্য। তবে চিত্তরঞ্জন গড়াই, কাজল ব্যানার্জি, তনুশ্রী ব্যানার্জি, রাজু ভল্লা, তাপস চট্টরাজ প্রমুখদের আপ্রাণ প্রচেষ্টা ও আপ্যায়নও অতুলনীয়। এমন আন্তরিকতারও কোনো বিকল্প হবে না।
তিরিশ ডিসেম্বর দুহাজার বাইশ সাঁইথিয়াতে দেবাশিস সাহা নীলাবতী সাহার উদ্যোগে ‘প্রগতি’ পত্রিকার আয়োজনেও লোকসংস্কৃতি উৎসব হয়ে গেল। সেখানেও আমোদপুর-ঈশ্বরপুর তেঁতুলতলার দল রায়বেঁশে খেলা দেখালো, আদিত্যপুর-কঙ্কালীতলার দল দেখিয়েছে মুখোশনৃত্য, পটেরগান, বাউলগান, মনসাগান, ভাদুগান সব হয়েছে। এও এক শিকড় সন্ধান। কৃষি ও কৃষ্টির সমন্বায়ক লোকউৎসব। মাটির টানে ঘরে ফেরার দিশা। উগ্র সংস্কৃতির বাইরে এক ধুলিধূসরিত নিজস্ব আলো। মাটির মমতায় মাখা লোক’জ মানুষের সম্প্রীতির সৃজন উৎসব। বহু শ্রোতা দর্শক এইসব অনুষ্ঠানে “অরিজিনাল” কথা সুর শুনতে চান। পানও। তবে অনেক জায়গায় আবার বাউল, একতারা গাবগুবি বাজাতেই পারে না। সব তারের যন্ত্র। বোলপুর পৌরসভার মঞ্চে শুনলাম আদিবাসী নাচের সঙ্গে “তু কেনে কাদা দিলি সাদা কাপড়ে”। এমনও থাকবে! তবে সেদিন মঞ্চে যখন আবেগাকুল কার্তিক দাস গাইছে “সুর বেঁধে দাও গুরু আমার সাধের একতারায়” তখন আশানন্দনের কথা আর তার এ প্লাস কন্ঠ অন্যভুবনের সন্ধান তো দেয়ই। আব্দুল হাসিবের জারি গান “ভাবনা জেগেছে মোদের মনে” যে মিলনের বার্তা দেয়, সেখানে “মাটিতে মাটিতে যোগ জুড়ে যায়” বাংলার মাটির গানে। আদতে এখানে তো মিলন ছাড়া আর কিছু নেই। রয়েছে মহা মিলনের বার্তাও। লোকসংস্কৃতির আঙনটি তাই শিকড়ে শিকড়ে মাটি দিয়েই গাঁথা।


