চলো মন ভান্ডীরবন

সনাতন সৌঃ

ভ্রমণ পিপাসু মানুষের কাছে একটি পরিচিত নাম শ্রীধাম ভান্ডীরবন।বৈষ্ণব শাক্ত আর শৈব ধর্মের পীঠস্থান মহা মিলনক্ষেত্র বীরভূমের গুপ্ত বৃন্দাবন। ভক্তি প্রকৃতি আর পুরাতত্ত্বের আকর্ষণে সেই প্রাচীনকাল থেকে আজও ছুটে আসে উৎসাহী মানুষের দল। এই মন্দিরের মনোরম দৃশ্য দেখে পদকর্তা কবি নীলকন্ঠ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন–বিভান্ডকের ভান্ডীরবন হেরিলে হরে মন, দ্বিতীয় বৃন্দাবন যথার্থ ব্রজধাম——‌।

দৈনন্দিন ব্যস্ত জীবন থেকে মনে আনন্দ পেতে কিংবা দেবতার অমোঘ আকর্ষণে মনের আকৃতি নিয়ে ও প্রকৃতির সান্নিধ্যে লাভ পেতে এখানে প্রায় প্রতিদিনই ছুটে আসছেন অসংখ্য পুণ্যকামী মানুষের দল। বীরভূম জেলার সদর শহর সিউড়ী থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার পশ্চিমে ময়ূরাক্ষী নদীর কোলেই অবস্থিত ভান্ডীরবনধাম। এখানে আসতে হলে সিউড়ী-আমজোড়া রাস্তায় যেতে হবে। বড়চাতুরী ব্লক হাসপাতালের কাছেই অবস্থিত। গ্রামের উপকন্ঠে বয়ে চলেছে ময়ূরাক্ষী নদী যার মাথার উপর নেমে এসেছে নীল আকাশ। গ্রামের চারপাশে রয়েছে গাছপালা আর বেশ কয়েকটি জলাশয় যা শরৎকালে ভান্ডীবনের শোভা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়। এখানকার প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশ দর্শনার্থীদের মনোরঞ্জন করে তোলে। এখানে একই সঙ্গে অবস্থান করছে বিভান্ডক মুণির ভান্ডেশ্বর শিব মন্দির, কিংবদন্তি সমৃদ্ধ রাজকীয় নয়নাভিরাম গোপাল জীউর মন্দির, সাধক যোগী সিদ্ধ পুরুষ স্বামী বিমলানন্দ সরস্বতীর আশ্রম। তার লাগাও বীরসিংহপুরে বীর রাজার আরাধিত মগধেশ্বরী কালী মন্দির ও বৈষ্ণব সাধক জ্ঞানদাস আশ্রম।

এবার আসা যাক বিভান্ডক মুণির ভান্ডেশ্বর শিব মন্দিরের আদি কথা। সে আজ থেকে বহু যুগের কথা। সে সময় ছিল গভীর দূর্ভেদ্য জঙ্গল। চলার পথ বলতে কিছুই ছিল না। সেখানে যেতে হলে চোখ খোলা রেখে কান খাড়া করে চলতে হতো। সেই ঘন জঙ্গলে ছিল ঋষি শৃঙ্গ মুণির পিতা ঋগ্বেদ স্রষ্ঠা বিভান্ডক মুণির পর্ণ কুটির। কঠোর তপস্যায় তিনি সিদ্ধ লাভ করেন সয়ম্ভু অনাদি লিঙ্গ শিবকে। তাই তাঁর নাম হলো ভান্ডেশ্বর শিব। কথিত আছে যে, এখানে ঋগ্বেদের ১০২৪ টি শ্লোক রচনা করা হয়েছিল। ভান্ডেশ্বর শিব বিভান্ডক মুণির প্রতিষ্ঠিত ও সেবিত। তাঁর নাম অনুসারে জনপদের নাম হয় ভান্ডীরবন। এখানকার মানুষের দৃঢ় বিশ্বাস, ভান্ডেশ্বর শিবের কাছে আসলেই সব কামনা সিদ্ধ হয়। একসময় বীরভূমের কনকপুর গ্রামের বাসিন্দা রমানাথ ভাদুড়ী মহাশয় নবাব আলীবর্দী খাঁর এর অধীনে উচ্চ রাজকাজে নিযুক্ত ছিলেন। বীরভূমের রাজনগরের রাজা আসাদুজ্জামানের বাকি পড়া খাজনা নিয়ে তদন্ত করতে আসেন নবাবের দেওয়ানজী রমানাথ ভাদুড়ী মহাশয়। ভান্ডীরবন এলাকায় পরিদর্শনকালে ভাদুড়ী মহাশয় কঠিন রোগে আক্রান্ত হোন এবং ভান্ডেশ্বর শিবের স্নানজল খেয়ে আরোগ্য লাভ করেন। তিনি পরম তৃপ্তি লাভ করে ভাণ্ডীরবন ধামের যাবতীয় বকেয়া পড়া খাজনা মুকুব করে দেন। ধর্মপ্রাণ দেওয়ানজী রমানাথ ভাদুড়ী মহাশয় ১৭৫৪ সালে ভাণ্ডীরবন ধামকে মনের মতো গড়ে তুলতে মুর্শিদাবাদ থেকে কারিগর আনিয়ে ভান্ডেশ্বর শিবের দেউল নির্মাণ করেন। মন্দিরের দেউলের উচ্চতর ১৫০ ফুট। মন্দিরের প্রবেশ পথে সদর গায়ে লেখা আছে ——,
রসাদ্ধি ষোড়শতকে সংখ্যকে শাস্ত্রসম্মতে
রমানাথদ্বিজঃ কশ্চিৎ ভাদুড়ীকুলসম্ভবঃ‌।
ভান্ডীরং শিবং দৃষ্ট্বা একান্তভক্তিসংযুতঃ‌
তৎপ্রীত্যর্থে বিনির্ম্মায় ইষ্টকময় মন্দিরং।।
বিচিত্রং রচিতং রম্যং রজতাভং পরিস্কৃতং
দদৌ শিবায় শান্তায় ব্রহ্মণে পরমাত্মনে
যাচতে তৎপদে ভক্তিং মুক্তিং বা দেহী শঙ্কর।
এই উৎকীর্ণ লিপির প্রথম পংক্তি থেকে জানা যায়, ১৬৭৬ শকাব্দে অর্থাৎ ১৭৫৪ খ্রিষ্টাব্দে এই শিব মন্দিরটি নির্মাণ হয়েছে ‌‌।
মন্দিরের চাতাল থেকে ফুট কুড়ি নীচে অবস্থান করছেন ভান্ডেশ্বর শিব। ভূপৃষ্ঠের গভীরে এক ঝলক পাথরের ন্যায় দৃশ্যমান তিনি। সাধারণত শিবলিঙ্গ হয় উত্তরমুখী কিন্তু এটি পশ্চিমলিঙ্গ। প্রবাদ আছে, একটি বিরাট সাদা সাপ শিবলিঙ্গকে জড়িয়ে থাকতো। মন্দিরের গর্ভে আছে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত শালগ্রাম শিলা। তাঁর পাশে বিরাজমান অষ্ট ধাতুর গোপাল ও পার্বতী। এখানে আছেন মঙ্গলচন্ডী। মন্দিরের প্রবেশদ্বার পেরুলেই ডানপাশে বিরাট অশ্বস্থ মূলে আসীন আছেন বটুক ভৈরব। এই বৃক্ষের নিচে কিছু ভগ্ন শিলামূর্তি আছে যা কালাপাহাড়ের কালানিদর্শন। অপরদিকে রয়েছে কয়েকটি ছোট শিব মন্দির। শিবরাত্রি ও গাজন উপলক্ষে প্রতি বছর এখানে মহোৎসব হয়। এছাড়া শ্রাবণ মাসের প্রতি সোমবার শিবের মাথায় জল ঢালার ভক্তদের ভিড় দেখা যায়। শিব মন্দিরের পাশেই পূর্বদিকে কিংবদন্তি সমৃদ্ধ রাজকীয় নয়নাভিরাম গোপাল জীউর মন্দির। উঁচু নহবতখানা, মন্দিরের প্রবেশদ্বার থেকে ঢুকলেই দেখা যাবে নাটমন্দির।তার সামনেই রয়েছে এক বুক উঁচু প্রাচীন ঢঙে তৈরি করা কারুকার্য মন্দির। এই মন্দিরের গৃহগর্ভে প্রতিষ্ঠিত অতি মনোরম গোপাল জীউর দারু মূর্তি। প্রত্যহ সকাল ও সন্ধ্যায় নহবত বাদ্যে যে কোনো মানুষের ভক্তি রসের সঞ্চার করে। সর্বত্রই সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের ছাপ রয়েছে। স্বভাবতই জানতে ইচ্ছা করে, গোপাল জীউর প্রতিষ্ঠার কথা। কিংবদন্তি আছে, বারোটি গোপাল নিয়ে বৃন্দাবনধাম থেকে নবদ্বীপধাম যাবার পথে ধ্রুব গোস্বামী নামে এক ধর্মপ্রাণ পরম বৈষ্ণব ভান্ডীরবনে আশ্রয় নেয়। ফিরে যাবার সময় এগারোটি বিগ্রহ নৌকায় উঠলেও শেষ বিগ্রহটির অত্যন্ত ওজন বেড়ে যাওয়ায় তাকে নৌকায় ওঠানো সম্ভব হয়নি। বাধ্য হয়ে গোস্বামীজী দ্বাদশ বিগ্রহকে ভান্ডীরবনে রেখে রওনা হোন নবদ্বীপধাম। এই বিগ্রহ ভান্ডীরবনে গোপাল মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরে রাজার দেওয়ানজী রমানাথ ভাদুড়ী রাজসিক গোপাল জীউর মন্দির নির্মাণ করিয়ে দেন‌ এবং গোপাল জীউর নামে এক হাজার জমি দান করেন। ১২৯২ বঙ্গাব্দে বর্ধমানের মহারাণী জানকীকুমারী ভান্ডীরবনের কাছে লাট হুকমাপুর নিলামে কিনে নেন এবং খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য লাঙ্গুলিয়া গ্রামে কাছারী বাড়ি তৈরি করেন। স্থানীয় ভক্তপ্রাণ মানুষের অনুরোধে তিনি গোপাল মন্দিরের সেবা পূজার দ্বায়িত্ব নেন। সুষ্ঠুভাবে মন্দির পরিচালনার জন্য ভক্ত সাধারণ নিয়ে একটি মন্ডল কমিটি গঠন করা হয়। অতঃপর ১৯৫৬ সালে সরকার জমিদারি স্বত্ববিলোপ আইন চালু হওয়ায় দেবদেবীর সেবাপূজার ক্ষেত্রে বিপর্যয় দেখা যায়। দেওয়ানজীর দেওয়া হাজার বিঘা নাগরাজ জমি প্রজাদের অধীনে চলে যায়। গোপাল জীউর সেবাপূজার ক্ষেত্রে উক্ত জমির আয় থেকে বঞ্চিত হয়। মন্দিরের জৌলুস কমে যায়, অতিথি আপ্যায়নে টান পড়ে। গোপাল জীউর সেবাপূজার জন্য শুরু হলো ভক্ত দানের উপর ভরসা। কথায় বলে ভক্তের ভগবান। জনসাধারণের দানে আজও চলে গোপাল জীউর সেবাপূজা। মন্দিরের দেখভাল ও গোপাল জীউর সেবাপূজা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। গোপাল জীউর দোলযাত্রা, রথযাত্রা, গোষ্ঠ ও রাসযাত্রা উপলক্ষে প্রতি বছর মন্দির প্রাঙ্গণে মেলা বসে। গোপাল মন্দিরের পাশেই উত্তর দিকে রয়েছে সাধক যোগী সিদ্ধ পুরুষ শ্রীমৎ স্বামী বিমলানন্দ সরস্বতীর আশ্রম। ইনি ভান্ডীবনে পঞ্চমুন্ডীর আসনে কঠোর তপস্যা করে সিদ্ধলাভ করেন। ১৩৩৩ বঙ্গাব্দে ৮ শ্রাবণ কাশীধামে ৮০ বছর বয়সে তাঁর মহাপ্রয়াণ ঘটে। তাঁর সহধর্মিণী সাধিকা দাক্ষায়ণী দেবী ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে অগ্রহায়ণ মাসে দেহত্যাগ করেন। তাঁর শিষ্য ও সেবকরা ভান্ভীরবনে সাধক ও সাধিকার শ্বেত পাথরের মূর্তি উক্ত আশ্রমে স্থাপন করেন।
ভান্ডীরবনের কাছেই অন্যতম আকর্ষণ বীরসিংহপুরে মগধেশ্বরী কালী মন্দির। কথিত আছে যে, মগধরাজ জরাসন্ধ বংশোদ্ভূত তিন ক্ষত্রীয় যুবক বীর সিংহ, চৈতন্য সিংহ এবং ফতে সিংহ ভাগ্য অন্বেষণে বঙ্গদেশে আসেন। বীর সিংহ বীরসিংহপুরে, ফতে সিংহ ফতেপুরে এবং চৈতন্য সিংহ চৈতন্যপুরে অর্থাৎ খটঙ্গায় রাজধানী স্থাপন করে রাজত্ব করেন। সঙ্গে নিয়ে আসেন কূলদেবী কালীকে। অতঃপর ১২২৬ সালে বাংলার সুবেদার গিয়াসউদ্দিন বলবন অতর্কিত আক্রমণ করে এবং সেই যুদ্ধে বীর সিংহ পরাজিত হোন এবং নিহতও হোন। পরের বছর গিয়াসউদ্দিনের মৃত্যু হলে বীর সিংহের বংশধরেরা বীরসিংহপুর থেকে চলে গিয়ে রাজনগরে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। সঙ্গে নিয়ে যান কূলদেবী কালীকে। রাজার উদ্যোগে রাজনগরের কালীদহ পুকুরের উত্তর পাড়ে দক্ষিণমুখী এক বিশালাকার মন্দিরে ওই কূলদেবী কালীকে প্রতিষ্ঠা করা হয়। অতঃপর ১৬০০ সালে ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ থেকে আগত দুই পাঠান বীরের অতর্কিত আক্রমণে বীর রাজাদের পতন ঘটে। কথিত রয়েছে, কালীদহের পুকুরের জল অপবিত্র হলে ওই কূলদেবী কালী কুশকরণীর নদী পথে আবার ফিরে আসে বীরসিংহপুরে। এখানে মূল মন্দিরে ঘটা করে কালী দেবীকে পুণঃ প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেই সময় থেকে আজও বীরসিংহপুরে মূল মন্দিরেই নিত্য সেবাপূজা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়। কালী মন্দিরের সামনে ও পিছনে বীর রাজার রাজত্বের বেশকিছু নিদর্শন ধ্বংসাবশেষ আজও নীরব সাক্ষী আছে। মহাকালীকে জাগ্রতা দেবী বিশ্বাসে আজও বহু দূর দূরান্ত থেকে অজস্র মানুষ দূরাগ্যো ব্যাধির হাত রেহাই পেতে বা মনোস্কামনা পূরণের জন্য মায়ের কাছে ধর্ণা দেন। মন্দিরের পাশেই পূর্বদিকে কালীদিঘির চারপাশে পাড় সবুজ গাছপালায় ঘেরা রয়েছে।
এছাড়া কালী মন্দিরের কাছেই আছে বৈষ্ণব সাধক জ্ঞানদাস আশ্রম। এখানে আছে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ। সেখানে প্রত্যহ নিত্য পূজা সহ প্রায় বিশেষ বিশেষ দিনে নানান ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয়। মন্দির পরিচালনা কমিটির উদ্যোগে ও ভক্ত সাধারণের সার্বিক সহযোগিতায় ভান্ডীরবনের মন্দিরগুলো আবার নবরূপে মেরামত করা হয়েছে। দর্শনার্থীদের মনোরঞ্জন করতে গোপাল জীউর জলাশয়টিতে একটি পার্কও তৈরি করা হয়েছে। সারা বছরই নানা উৎসব ও মেলায় মুখরিত হয় ভান্ডীরবনধাম। তাই এই মনোরম দৃশ্য দেখে বাউল সম্রাট পূর্ণচন্দ্র দাসবাউল গান গেয়ে আকাশ বাতাস মাতিয়ে তুলেছেন —
“ভান্ডীরবনে ভান্ডেশ্বর শিব
তার পাশে গোপাল করে খেলা,
দেশ বিদেশের মানুষ গো যাও
এ বীরভূম ঘুরে ——“।
প্রখ্যাত লোক সঙ্গীত শিল্পী রতন কাহার গাইলেন—
“তোমরা বীরভূমে ঘুরে ঘুরে দেখো গো –
রাজনগরের কালী বীরসিংহপুরে,
তোমরা নয়নভরে দেখো গো
ভান্ডীরবনে গোপাল আর শিব ঠাকুরকে—–“।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *