কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ইতিহাস ও বর্তমান পরিস্থিতি

নয়াপ্রজন্ম প্রতিবেদনঃ

কাশ্মীর উপত্যকা শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যই নয়, তার সমৃদ্ধ ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চার জন্যও বিখ্যাত। এই অঞ্চলের অন্যতম প্রাচীন ও বিদ্বান জনগোষ্ঠী হল কাশ্মীরি পণ্ডিতরা। তারা হিন্দু ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ভুক্ত এবং বহু শতাব্দী ধরে কাশ্মীরে বসবাস করে আসছেন। তাঁদের ইতিহাস, অবদান, নির্যাতনের কাহিনি ও বর্তমান পরিস্থিতি আজও ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ইতিহাস
কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ইতিহাস প্রায় ৫,০০০ বছরের পুরনো। বৈদিক যুগ থেকে শুরু করে মধ্যযুগ পর্যন্ত কাশ্মীর ছিল জ্ঞান, দর্শন ও সাহিত্যের এক বিশাল কেন্দ্র, যার মূল চালিকা শক্তি ছিলেন পণ্ডিতরা। সংষ্কৃত ভাষায় লেখা বহু দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক ও সাহিত্যিক রচনা এখান থেকেই উৎপত্তি লাভ করেছে। অদ্বৈত বেদান্ত, কাশ্মীর শৈবদর্শন ও ন্যায় দর্শনের বিকাশে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের বিশেষ ভূমিকা ছিল। রাজা ললিতাদিত্য থেকে শুরু করে অবন্তিবর্মার মতো বহু রাজা কাশ্মীরি পণ্ডিতদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তারা শুধু ধর্মীয় কার্যকলাপে সীমাবদ্ধ ছিলেন না বরং প্রশাসন, চিকিৎসা, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রভৃতি ক্ষেত্রেও দক্ষতা দেখিয়েছেন।
ইসলাম আগমন ও পরিবর্তন
তেরোশো শতক থেকে কাশ্মীরে ইসলাম ধর্মের প্রভাব বাড়তে থাকে। সুফি সাধকরা শান্তিপূর্ণভাবে ইসলাম প্রচার করেন এবং মুসলিম জনসংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। অনেক পণ্ডিত ইসলাম গ্রহণ করেন, তবে অনেকেই তাঁদের ধর্ম ও ঐতিহ্য রক্ষা করে টিকে থাকেন। এর মধ্যেই কাশ্মীরে একধরনের ধর্মীয় সহাবস্থান দেখা যায়। কিন্তু কিছু সময়ে ধর্মীয় নিপীড়নের ঘটনাও ঘটে, বিশেষ করে সুলতান সিকান্দর বুতশিকনের রাজত্বে (১৪শ শতাব্দীর শেষ দিকে)। তখন বহু মন্দির ধ্বংস হয় এবং অনেক হিন্দুকে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করা হয়। যদিও পরবর্তীকালে সহনশীলতা ফিরে আসে, তবুও এই ঘটনার প্রভাব কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ইতিহাসে গভীর ছাপ ফেলে।
আধুনিক সময়ে উৎখাত ও নিপীড়ন
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পরে কাশ্মীর ভারতের অন্তর্ভুক্ত হলেও সেখানে বিশেষ রাজনৈতিক অবস্থান বজায় রাখা হয়। ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে উপত্যকায় বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। এর ফলে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ওপর ব্যাপক হামলা ও হত্যাকাণ্ড শুরু হয়।
১৯৯০ সালে সন্ত্রাসবাদের চরম পর্বে কয়েকশো কাশ্মীরি পণ্ডিতকে হত্যা করা হয় এবং লক্ষাধিক মানুষ প্রাণভয়ে উপত্যকা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। তাদের বাড়িঘর, মন্দির, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়। বহু পরিবার দিল্লি, জম্মু ও দেশের অন্যান্য অংশে উদ্বাস্তু হয়ে জীবন কাটাতে শুরু করে। এই ঘটনাকে অনেকেই “জাতিগত নিধন” বা “ধর্মীয় নিপীড়ন” বলে অভিহিত করেন।
বর্তমান পরিস্থিতি
বর্তমানে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের সংখ্যা কাশ্মীর উপত্যকায় খুবই নগণ্য। যদিও ভারতের কেন্দ্র সরকার ও জম্মু-কাশ্মীর প্রশাসন তাঁদের পুনর্বাসনের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, কিন্তু নিরাপত্তার অভাব, আর্থিক দুরবস্থা ও মানসিক আঘাত এখনো তাঁদের ফিরে যাওয়ার পথে প্রধান বাধা।
২০১৯ সালে ভারত সরকার সংবিধানের ৩৭০ ধারা রদ করে জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা তুলে নেয়। এরপর কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের আওতায় পুনর্গঠন করা হয়। এই পরিবর্তনের ফলে কিছু উন্নয়ন প্রকল্প ও পুনর্বাসন নীতি গৃহীত হয়েছে, যার আওতায় কিছু পণ্ডিত পরিবার আবার কাশ্মীরে ফিরে গেছেন, তবে সংখ্যা এখনও খুবই কম।
কাশ্মীরি পণ্ডিতদের অবদান ও ভবিষ্যৎ
কাশ্মীরি পণ্ডিতদের অবদান ভারতীয় সংস্কৃতি ও সমাজে অসামান্য। রাজনীতি, বিজ্ঞান, সাহিত্য, সিনেমা ও শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁদের বিচরণ আজও বর্তমান।
তাঁদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে একটি নিরাপদ, ধর্মনিরপেক্ষ ও সহনশীল পরিবেশ তৈরির ওপর, যেখানে তাঁরা আবার তাঁদের পূর্বপুরুষদের ভূমিতে শান্তিতে বসবাস করতে পারবেন।
কাশ্মীরি পণ্ডিতদের কাহিনি একদিকে যেমন গৌরবের, তেমনি দুঃখেরও। তাঁদের ইতিহাস কেবল কাশ্মীর নয়, বরং সমগ্র ভারতের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তাঁদের প্রতি ন্যায়বিচার, পুনর্বাসন ও সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়া শুধু মানবিক কর্তব্য নয়, বরং ভারতীয় গণতন্ত্রের একটি বড় পরীক্ষা।
নিচে কিছু উল্লেখযোগ্য কাশ্মীরি পণ্ডিতদের নাম ও তাঁদের অবদান তুলে ধরা হলো, যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের পরিচিতি ও গৌরব ধরে রেখেছেন:

বিজ্ঞান, শিক্ষা ও সাহিত্য

ব্রিজলাল কাক – ঐতিহাসিক, প্রত্নতত্ত্ববিদ ও প্রশাসক; কাশ্মীরের ইতিহাস নিয়ে বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন।কলহণ (ঐতিহাসিক, যদিও প্রাচীন) – তাঁর লেখা “রাজতারঙ্গিনী” কাশ্মীরের ইতিহাসের অন্যতম প্রামাণ্য দলিল। জ্যোতি সুরি – লেখক ও সমাজকর্মী, যিনি কাশ্মীরি পণ্ডিতদের বাস্তুচ্যুতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে সচেতনতা তৈরি করেছেন।

চলচ্চিত্র ও বিনোদন

অনুপম খের – আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেতা, প্রাক্তন FTII চেয়ারম্যান এবং কাশ্মীরি পণ্ডিতদের মুখপাত্র হিসেবে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছেন।

সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম

রাহুল পান্ডিতা – সাংবাদিক, লেখক ও কলামিস্ট; তাঁর লেখা “Our Moon Has Blood Clots” কাশ্মীরি পণ্ডিতদের বাস্তুচ্যুতি নিয়ে এক মর্মস্পর্শী বই।
এই ব্যক্তিত্বরা তাঁদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফলতার পাশাপাশি কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অধিকার রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *