উত্তম মণ্ডলঃ
মৃত্যুর পুনর্নিমাণ আমাদের জানা নেই। তবু ২৮শে ফেব্রুয়ারী সকালে মুঠোফোন খুলতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠলো দুঃসংবাদ। নয়াপ্রজন্ম পএিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক কাঞ্চন সরকার, মানে আমদের প্রিয়জন কাঞ্চনদা আর আমাদের মধ্যে নেই। মুহূর্তেই কাঞ্চন স্মৃতি নিয়ে অভিভাবকহীন হয়ে গেলাম আমরা। প্রায় ৩০ বছরের সম্পর্ক এভাবে যে শেষ হয়ে যাবে, এখনও ভাবতে পারছি না। মনে হচ্ছে, এ যেন এক দুঃস্বপ্ন! ঘুম ভাঙলেই জানবো, কাঞ্চনদা রয়েছেন ‘নয়াপ্রজন্ম দপ্তরে’, ‘সবুজের অভিযান’ মঞ্চে। তবুও সিউড়ি এলাম। কিছুক্ষণ পরেই ‘নয়াপ্রজন্ম’ দপ্তরে এলেন কাঞ্চনদা। তবে হেঁটে নয়, ফুলের সাজে সেজে নীরব হয়ে শববাহী গাড়িতে শুয়ে। সত্যিই সংবাদ জগতের লোক হয়েও এ দুসংবাদ মানতে পারছি না এখনও। ৬০বছরে এত কাজ অসমাপ্ত রেখে সত্যিই কি মেনে নেওয়া যায় এভাবে চলে যাওয়া?
নয়াপ্রজন্ম পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যা থেকেই আমি লিখে আসছি। দপ্তর তখন সিউড়ির টিকাপাড়ার এক চিলতে গলিতে। লেটার প্রেসে সারাদিন ঘটাঘট শব্দ আর তারপর সপ্তাহ শেষে প্রতি বুধবার অপেক্ষা। কারণ, বুধবার বের হতো নয়াপ্রজন্ম। তারপর জেলা জু়ড়ে ঝড়। পুরোনো একটি স্কুটারে চড়ে জেলা চষে বেড়াচ্ছেন কাঞ্চনদা। খবর বেরোনোর পর সমালোচনা। কেউ রইলেন আনন্দে, কারো উড়ে গেল রাতের ঘুম। কারণ, তাকে কাঞ্চন সরকারের নয়াপ্রজন্ম ধরেছে। একবারে মোক্ষম কামড়। নো-কম্প্রোমাইজ। খবরটা তখন খবরই। একেবারে আঁখো দেখা হাল্।কোমরে দড়ি দিয়ে প্রকাশ্য রাস্তায় তাঁকে হাঁটানো হয়েছে। তবুও তাঁর উন্নত শির কোনো অন্যায়ের সঙ্গে আপোস করেনি। এরকম দুঃসাহসী সম্পাদক বীরভূম এর আগে দেখেনি। বীরভূমের একচক্রা গ্রামে নিত্যানন্দ প্রভূর জন্মস্থান দেখতে গিয়েছি কাঞ্চনদার সঙ্গে। দুপুর গড়িয়ে গেছে। নিতাই ধামের সদর দরজা বন্ধ। বাইরে দাঁড়িয়ে কাঞ্চনদা মুঠোফোনে কাকে যেন ফোন করতেই চিচিং ফাঁকের মতোই খুলে গেলে দরজা। তারপর একগাল হেসে সাদর আপ্যায়ন,ভেতরে আসুন। কাঞ্চনদার সফরসঙ্গী হয়ে জুটলো পাতার ঠোঙায় নিতাইচাঁদের দরবারের পায়েস প্রসাদ। সে প্রসাদী পায়েসের স্বাদ গন্ধ এখনও আমার মুখে-নাকে লেগে রয়েছে যেন। অতদূরের কথা কেন। এবার পুজোর পর দুপুরে আমার বাড়িতে নিজেই চারচাকা চালিয়ে হাজির কাঞ্চনদা। এসেছেন অনেকবার। এলেই বাড়ির সব কাজ থেমে যেতো। সেবারও হলো। পরিবারের সঙ্গে হৈচৈ। তারপর আমাকে গাড়িতে চাপিয়ে সাংবাদিক মহঃ সফিউল আলম ও বাচিক শিল্পী প্রভাত দত্তকে পথে তুলে নিয়ে এলাকায় চক্কর দেওয়া, মাঝে নয়াপ্রজন্ম’র এককদা সাংবাদিক সুভাষ মাজীর সঙ্গে ঘোরতর আড্ডা। সব মিলিয়ে এখনো যেন কাঞ্চন স্মৃতি।
হঠাৎ মৃত্যু এসে যেমন কাঞ্চনদাকে নিয়ে চলে গেল, তেমনি এই লেখা লিখতে গিয়েও সব যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে আমার। আসলে অভিভাবকহীন হলে যা হয়। আমার সম্পর্কে কাঞ্চনদার লিখিত মূল্যায়ন ছিল উত্তম মণ্ডলের কলম ‘উত্তম কলম’। আর এভাবে এককথায় কে বলবে এ কথা? কাঞ্চনদাকে শেষ দেখা দেখতে এসে বর্তমান সম্পাদক অজয় দাসের কথায় নয়াপ্রজন্ম দপ্তরে বসে ইলিখলাম এই এলোমেলো লেখা। ফি বছর পয়লা জানুয়ারী কল্পতরু দিবসে নয়াপ্রজন্ম-র বর্ণময় অনুষ্ঠান সারা বছর মনে রাখার মতো ছিল। সারাদিন অনুষ্ঠান, তারপর সবুজের অভিযান-এ রাত্রি যাপন। সারারাত সাংবাদিক বন্ধুদের সঙ্গে নির্ভেজাল আড্ডা। আর সে আড্ডার মধ্যমণি কাঞ্চনদা। এরপর খাওয়া-দাওয়া শেষে কাঞ্চনদাও শুয়ে পড়তেন আমাদের সঙ্গে। এছাড়াও মাঝে মাঝেই অনুষ্ঠান আর আড্ডা লেগেই থাকতো। তখনও সবুজের অভিযান অঙ্গনে ‘বসুন্ধরা’ মঞ্চ হয়নি। ওই বাড়ির ছাদেই রাতে কখনো সাদা ভাত, কখনো বা রাণিং খিচুড়ি। যে ঝোলা খিচুড়ি পাতে পড়লেই দৌড়োয়, তার নাম রাণিং খিচুড়ি। নামটা আমারই দেওয়া এবং এ নিয়ে সাংবাদিক বন্ধুদের মধ্যে রসিকতাও হয়েছে বিস্তর। এরপর তো বসুন্ধরা মঞ্চ হলো। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কাঞ্চনদার সঙ্গে সঞ্চালনায় অংশ নিলাম। মঞ্চের দুদিকে দুটো মাইক্রোফোন। একটায় আমি, আরেকটায় কাঞ্চনদা। মঞ্চে আনন্দবাজার পত্রিকার স্বাতী ভট্টাচার্য থেকে বহু বিশিষ্টজনেরা। উৎরে গেলাম কাঞ্চনদার সৌজন্য়ে। সেবারও রাত্রি যাপন। সকালে উঠে কাঞ্চনদার সঙ্গে আরেক প্রস্থ আড্ডা দিয়ে আকাশবাণীর সংবাদিক বন্ধু শম্ভুনাথ সেন, ও আরেক সাংবাদিক বন্ধু সেখ রিয়াজউদ্দিনের সঙ্গে বাড়ির পথে। এ লেখা যখন লিখছি, কলকাতা থেকে ফোন এলো। ফোনের ওপারে একদা নয়াপ্রজন্ম-র সাংবাদিক বন্ধু মহঃ নুরেন্নবী। উদ্বিগ্ন, শোকস্তব্ধ। এভাবেই বহু কাঞ্চনপ্রেমী মানুষ বার বার ফোনে খবর জানতে চেয়েছেন। বুঝেছি, কাঞ্চনদার ব্যাপ্তি ও বিশালতা। মনের অনেক না-বলা কথা অব্যক্তিই থেকে গেল। তবে আর তো শাসন করার কেউ রইলো না। তাই থেমে গেলেও কেউ কিছু বলবে না। বটগাছ নেই, অনিকেত পাখিগুলোর শুধুই এখন ডানা ঝটফটানি।
যে শিরোনাম দিয়ে শুরু করেছিলাম, চিতাতেই উঠলেন না কাঞ্চনদা। সত্যিই তাই। ‘সবুজের অভিযান’ থেকে তাঁর ফুলে ফুলে ঢাকা মরদেহ চলে গেল ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে বিবেকানন্দ হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজে। ইচ্ছাপত্র তৈরী হয়েছিল আগেই। কাঞ্চনদার সঙ্গে নিতাই ধাম যাওয়ার পথে এই কলেজে এসেছিলাম। কয়েক বছর হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকদের সংগঠন ‘হোমাই’-এর সম্মেলন আয়োজিত হয়েছিল সিউড়ী সবুজের অভিযান মঞ্চে এবং অবশ্যই কাঞ্চনদার উদ্যোগে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত বাংলা দৈনিক ‘একদিন’-এ বীরভূম জেলার খবরের পাতার দায়িত্ব নিয়েছিলেন কাঞ্চনদা। আমরাও ছিলাম কুশীলব হিসেবে। সারাদিন কেটেছে অসম্ভব এক ব্যস্ততায়। সব মিলে কাঞ্চন সরকার নিজেই একটি স্বয়ংশাসিত প্রতিষ্ঠান। অকৃতদার কাঞ্চনদার হাড়গুলোও এখন কাজ করে যাবে বিবেকানন্দ হোমিওপ্যাথি কলেজের ভাবী চিকিৎসকদের জন্য। চিতাতে না উঠে এভাবেই এক অপ্রচলিত বিষ্ময় হঠাৎ করেই চলে গেলেন অন্তরালে। তবুও মৃত্যুহীন এই প্রাণ বিবেকানন্দ হোমিওপ্যাথি কলেজের ভাবী চিকিৎসকদের বহু মৃত্যুকে আটকাতে সাহায্য করবে। এখন এটাই আমাদের অহংকারী সান্ত্বনা। অপেক্ষা শুধু সময়ের। তবুও মনে হচ্ছে, এ মৃত্যু আমাদের কাছে হিমালয়ের মতোই যেন ভারী। শুধু মস্তিষ্ক নয়, হৃদয়েও থাকুন কাঞ্চনদা—কাঞ্চন সরকার।
ভারতবর্ষে ঋগ্বেদের ঋষিরা আকুল কণ্ঠে বলেছিলেন,—“বাধশ্ব দূরে নিঋর্তিং।” অর্থাৎ, অকল্যাণী নিয়তিকে দূরে বেঁধে রাখো। কিন্তু তাকে বাঁধা যায়নি। আবার ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ দেখে অর্জুন বলেছেন,—“লেলিহাসে প্রসমানঃ সম্ভাৎ লোকান্ মরুগ্রাম বদনৈর্জলদ্ভিঃ। তেজো ভরা সূর্য জগৎ সমগ্রং ভাসন্তভিরোগ্রা প্রতিপন্তি বিষ্ণো।” অর্থাৎ, বঝেছি, নিয়তি তুমি। উদ্দেশ্য তোমার অনিবার্য। প্রতিরোধ যত বলবানই হোক, নিস্তার নেই। তাই তোমার অগ্নিময় করাল গ্রাসে এই সমস্ত লোক দগ্ধ বিনষ্ট। তাই চলে যেতে হয় আর যেতে দিতেই হয়। কোনো কর্মই অবিমিশ্র সুখ দিতে পারে না। তবে কর্মেই অমরত্ব পায় মানুষ। চিতাতে না উঠে কাঞ্চনদা প্রমাণ করে গেলেন, এভাবেও বেঁচে থাকা যায়।
ভালো থাকুন কাঞ্চনদা।
Asadharan…….Anobadyo…..Atuloneo…….swachchha bhabnar nirbhejal bohiprokash sundor lekhoneer madhyome dhara poreche…….Kanchaner sathe jara jebhabe misheche tara sebhabe or sampatke smriti charon korbe eta bala bahulyo……mon chue jaoa akta lekha porlam ato manasik kashter modhyeo bheeshan khushi holam pathok / didi hisabe