নাসিম-এ-আলমঃ
কাঞ্চনকে নিয়ে এতো দ্রুত এতো সময়ের কালবেলার স্মতিআলেখ্য লিখতে হবে ভাবতে পারিনি। এই তো কিছুদিনের আগে পরে কবি প্রদীপ মিত্র, সাংবাদিক গোপাল চট্টোপাধ্যায়, কবি গৌতম দাস, ভাবিনি পরের নামটি কাঞ্চন সরকার। ক্রমাগত স্বপ্ন দেখতে একজীবনে এতোটা অকস্মাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো স্বপ্নের বিরতি ঘটবে ভাবা যায়! আসলে আমরা তো গরপরতা সাধারণ মানুষ, ভাববোইবা কীভাবে।
আমার সঙ্গে আলাপ ১৯৯২ সালে। না কোনো অনুষ্ঠানে নয়, একটি পত্রিকার স্টলের সামনে তখন আপনি দিয়ে শুরু। বললেন, অফিস চলুন। নয়াপ্রজন্মের নাম শুনেছি তখন। অফিসে গেলাম। সেই যাতায়াত নিয়মিত হলো। কাঞ্চন আত্মীয়তা গড়তে জানতো। আত্মীয় হতে পারতো। হ্যাঁ, সেই ১৯৯২ আর আজ সর্বনাশের শীতল জানুয়ারীর ২০২২। ৩০ বছর। কোথাও কোনো বিরতি, অভিমান, বিচ্ছেদ ছিল না। নয়াপ্রজন্মের প্রতিটি কর্মকাণ্ডে আমাকে জড়িয়ে নিয়েছিল। সেই অনুষ্ঠান বা বিশেষ সংখ্যা হোক। কতোটা পথ পেরোলে তবে পথিক হওয়া যায় তা আমরা কাঞ্চনের কাছে শিখেছিলাম। নয়াপ্রজন্মের খুব কাছের জন হয়ে উঠেছিল যাঁরা তাঁদের নামগুলি একবার দেখে নিই—আদিত্য মুখোপাধ্যায়, তপন গোস্বামী, নীলোৎপল ভট্টাচার্য, অজয় দাস, সনাতন সৌ, মহঃ সফিউল আলম, সমরেশ মণ্ডল, প্রয়াত সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, অনিতা মুখোপাধ্যায়, দেবযানী দাস সিনহা, সোমনাথ মুখোপাধ্যায় অনেক গুণী লেখক-কবি-শিল্পী, কারোর নাম বাদ যেতে পারে। কিছু মনে করবেন না আশা করি। এখন মনের যা অবস্থা অনেককিছুই ভুল হয়ে যাচ্ছে।
হ্যাঁ বীরভূমের পথিক হয়ে ওঠা, ঝাড়খণ্ড লাগোয়া বীরভূম খেকে কীর্ণাহারা, নানুর, মুরারই, রাজগ্রাম থেকে বোলপুর হাতের তালুর মতোই চিনতো কাঞ্চন। ভালোবাসতো বলেই চিনতো, সেই ভালোবাসা নিজের শহর থেকে রাজ্য, দেশ হ্যাঁ গড়ে উঠেছিল দশভাবনা। আর সেই দেশভাবনা অর্থে তাঁর কাছে ছিল বীরভূম। বীরভূমকে আর কেউ এতো ভালোবেসেছে কিনা আমার জানা নেই। শুধু ভালোবাসি বলে হাত ধুয়ে ফেলা নয়, নয়াপ্রজন্মের হাত ধরে বীরভূমের সংস্কৃতির গভীরে প্রবেশ করতে চেয়েছিল কাঞ্চন। কে না চিনতেন তাঁকে! একবার বিকেলে অফিস ফেরৎ সাঁইথিয়া স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি—হঠাৎ দেখি কাঞ্চন। কলকাতা যাবে। এবার শুরু হল দাদা কেমন আছেন? ট্রেন এলো আধ ঘন্টা পর। কাঞ্চনের সাথে কুশল বিনিময় করলেন অন্তত ৩০ জন। এতো পরিচিতি, এতো সখ্যতা, সেই সখ্যতাই কোনো কৃত্রিমতা নেই। নিপাট খাঁটিত্ব রয়েছে। এখানেই কাঞ্চন সরকার স্বতন্ত্র, পৃথক ঘরানার এক ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তি বা সাংবাদিক বা সমাজকর্মী সকলের কাছে আদর্শ। নয়াপ্রজন্মের বিশেষ সংখ্যাগুলির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলে কাজের প্রতি তাঁর আন্তরিকতা টের পাওয়া যাবে। রমারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, দেবরঞ্জন মুখোপাধ্যায়, কবিরুল ইসলাম, প্রণব মুখোপাধ্যায়, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়—প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রকাশপর্বে বিশেষ অনুষ্ঠান। এর মধ্যে কবিরুল ইসলাম সংখ্যার দায়িত্ব ছিল আমার উপর। প্রথম থেকে দেখেছি এতোটা কাজকে নিপুণভাবে কীভাবে সামাল দিতে হয়। লিট্ল ম্যাগাজিন মেলা, সাহিত্য অনুষ্ঠান—এসব তো বিগত ৩০ বছরে প্রায়ই হয়েছে। কিছুদিন বন্ধ হয়ে গেলেও প্রতিবছর ১ জানুয়ারী কল্পতরু দিবসে নিয়মিত অনুষ্ঠান হয়েছে। নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন বিষয়কে ভাবতে পারতো কাঞ্চন। ভাবতাম সামলাচ্ছে কী করে, অথচ সফলভাবে সবকিছু সামলে দিত সে। আমি কেন বীরভূমের সকল সাহিত্যপ্রেমী নিশ্চিন্ত থাকতো কারণ আর কেউ না, কাঞ্চন সরকার রয়েছেন। নিজেকে আলোয় আনতে চাইতো না। সে অন্যকে প্রচারের আলোয় আনতো। বীরভূমে এমন কেউই নেই প্রায় যিনি নয়াপ্রজন্ম কর্তৃক সংবর্ধিত নন বা সম্মানপ্রাপ্ত নন। এছাড়াও নারীনক্ষত্র সম্মাননা, শিক্ষক সংবর্ধনা…আরও রয়েছে সবটা মনে নেই। ৩০ বছর ধরে এক কথায় বীরভূমকে সর্বস্ব দিয়েছিল কাঞ্চন। বিনিময়ে কিছুই চায়নি। প্রচারের আলো থেকে দূরে শুধু বীরভূম নিয়ে এতো কাজ করা যায় তা আমরা ভাবতে পারিনি। ভোগবাদের এই যুগে কাঞ্চনের মূল্যায়ণ করা কিছুটা কষ্টকর। বিশেষ করে যখন ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া মাথা তুললো, শপিংমল বহুতল মাথা তুলতে শুরু করলো, দূরদর্শন নিয়ে এলো তার শতাধিক চ্যানেল, মানুষের কাছে যা এতোদিন অধরা ছিল তার ধরা দিল হাতের কাছে। ১৯৯০ দশক থেকে এসব ভোগবাদী জীবন হাতছানি দিচ্ছে মানুষকে। কাঞ্চনের নয়াপ্রজন্মের য়াত্রা শুরু সেই ৯-এর দশকের সূচনায়। সবাই তখন নিজের কথা ভাবতে শুরু করলো। কাঞ্চন ভাবতে শুরু করলো মানুষের কথা। মানুষকে নিয়ে তাঁর স্বপ্ন—সেই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে সকাল-বিকেল তাঁর ছোটাছুটি সারা বীরভূমজুড়ে।
এক কথায় বলা যায় অন্য সকলের জন্য রইল গৃহ আর কাঞ্চনের জন্য বাইরের পৃ়থিবী। তারজন্য নিজস্ব গৃহ বন্ধক দেওয়া, ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নেওয়া কী না করেনি আমাদের কাছের মানুষ কাঞ্চন সরকার—-আর সকলের জন্য ছিল কেরিয়ার, চাকরি, বিয়ে, বাড়িঘর নির্মাণ, ছেলেমেয়ের ইংলিশ মিডিয়াম। নয়াপ্রজন্ম’র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক কাঞ্চন নির্মাণ করলেন নবজাতক স্কুল, বসুন্ধরা মঞ্চ। নবজাতকের শিশুদের পাঠদান করা হতো। বসুন্ধরা মঞ্চটি না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না, বীরভূমে এতো অভিজাত সুন্দর ও নিপুণ মঞ্চ ও সাহিত্যিক, শিল্পী, চিকিৎসক, সমাজকর্মী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বীরভূম নয়, সারা পশ্চিমবঙ্গের গুণী ব্যক্তিত্ব এখানে উপস্হিত হয়েছেন। এসবও কম কথা নয়। নিজস্ব খ্যাতির তোয়াক্কা করেনি কাঞ্চন বরং রাজ্যের খ্যাতিমানদের হাজির করিয়েছেন বীরভূমের বুকে। ওই যে বলেছিলাম বীরভূম ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান-স্বপ্ন।
আমারও মনে হয় প্রায় কেউই তাঁর মৃত্যু পূর্ব পর্যন্ত তাঁকে নিয়ে এতো কথা ভাবেননি। বিয়ে করেননি কাঞ্চন। এক ও একাকী ছিল তাঁর জীবন। হয়তো সংসারের বন্ধনে আবদ্ধ হলে এতো কিছু করা সম্ভব হতো না। দ্বিতীয়বারের জন্য কাঞ্চনের মতো আর কাউকে আমরা পাবো কিনা সেই প্রশ্নের উত্তর আগামীর জন্য তোলা রইল। কাঞ্চনের কর্মকাণ্ড বেঁচে থাকবে কিনা— এসব এখন সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষকে ভাবাচ্ছে। সত্যিই তো এগুলো রক্ষা করা সহজ কাজ নয়। তাঁকে নিয়ে লেখাটা জটিল কারণ কোনো জটিলতা, গোপনীয়তা নয়, সরাসরি কর্মমুখর ত্যাগ স্বীকার করা এক জীবন। ভীষণভাবে এগুলো লক্ষ্য করেছি এতোদিন। যেদিন আলাপ হয়েছিলে সেদিন থেকে শেষ বিদায়ের দিন পর্যন্ত অকাতরে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার নাম কাঞ্চন সরকার। গড়পরতা মানুষের পক্ষে যা স্বপ্নেরও অতীত সেটা সে করে দেখিয়েছে। একদম শেষে দেহদান করে গেছে সাঁইথিয়া হোমিওপ্যাথ কলেজে। অ্যানাটমি বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের গবেষণা ও হাতেকলমে শিক্ষার জন্য মানবদেহ ভীষণ জরুরী। কাঞ্চন সেই প্রয়োজন মিটিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিল। মহাকাব্যের ট্র্যাজিক নায়কের জীবন যে শুধু দিতে জানে, বিনিময়ে নেয় না কিছু। আর কাজ শেষ করে চোখের জলে মানুষকে ভাসিয়ে বিদায় নেয়। মহাকাব্যের নায়ক আমার কাছে কাঞ্চন সেই যুগনায়কের নাম।