যে শূন্যস্থান কখনো পূরণ হবার নয়

মেহের সেখ:

আমাদের সকলেরই একদিন না একদিন মৃত্যু হবে। কিন্তু বেশ কিছু মানুষের মৃত্যু আমাদেরকে এবং আমাদের সমাজকে ভীষণ ভাবে নাড়িয়ে দেয় । সেই সব মানুষের মৃত্যুতে আমাদের সমাজের যে ক্ষতি হয় সেটা পূরণ করা তখন খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। নয়াপ্রজন্ম সাপ্তাহিক সংবাদপত্রের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক কাঞ্চন সরকার দাদা তেমনই একজন মানুষ ।যার শূন্যস্থান কখনো পূরণ হবার নয়। কাঞ্চনদা বীরভূমের প্রতি অসম্ভব রকমের একটি টান তথা দরদ অনুভব করতেন। বীরভূমের সাহিত্য -সংস্কৃতি চর্চা ,বীরভূমের ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গুলো নিয়ে তথা বীরভূম জেলাকে নিয়ে কাঞ্চন সরকার দাদার মতো করে ভাববার মানুষ বীরভূম জেলায় খুব কম জনই জন্মেছেন । বীরভূমের সর্বাধিক প্রচারিত (ত্রিশ বছরের পুরোনো) নয়াপ্রজন্ম সাপ্তাহিক সংবাদপত্রের মধ্যে দিয়ে কাঞ্চন সরকার দাদা বীরভূমের ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তুলে ধরা থেকে শুরু করে জেলার ক্ষুদে প্রতিভাকে প্রকাশ্যে আনতেন।জেলার অনেক অনামী বিস্মৃতপ্রায় লেখকদেরও কাঞ্চনদা নয়াপ্রজন্মের মধ্যে দিয়ে প্রচারের আলোতে নিয়ে আসতেন । এমনকি কাঞ্চনদার নয়াপ্রজন্ম সাপ্তাহিক সংবাদপত্রের পাতায় সাংবাদিকতার হাতে খড়ি নিয়ে অনেকেই পরবর্তীতে জেলা তথা রাজ্যের জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম গুলোতে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন।বীরভূমের অনেক কম বয়সী সাংবাদিকদের অভিভাবকের মতো ছিলেন কাঞ্চনদা ।কাঞ্চনদা ব্যক্তিগত জীবনে কাউকে তাঁর বিরোধী পক্ষের বলে ভাবতেন না। তাঁর বিপক্ষে থাকা মানুষদের ডেকেও কাজের নিরিখে তাদের সম্মানিত করতেন ।উৎসাহ জোগাতেন।
আমার সাথে কাঞ্চনদার পরিচয় কয়েক বছরের। অভিভাবকের মতোই এই কয়েক বছর কাঞ্চনদা আমাকে বিভিন্ন বিষয়ে সুপরামর্শ দিয়ে গাইড করেছেন । কয়েক বছর আগে কাঞ্চনদা আমাকে একদিন বসুন্ধরা মঞ্চ ঘুরে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন । আমি আমার সময় মতো একদিন এসে কাঞ্চনদার সবুজের অভিযানে বসুন্ধরা মঞ্চ ঘুরে দেখেছিলাম। বসুন্ধরা মঞ্চ ঘুরে ঘুরে সমস্তটাই সেদিন দেখিয়েছিলেন কাঞ্চনদা ।সঙ্গে চা এবং জলযোগের ব্যবস্থাও করেছিলেন কাঞ্চনদা। সিউড়ির সবুজের অভিযানে কাঞ্চনদার প্রতিষ্ঠিত বসুন্ধরা মঞ্চের কর্মকান্ড দেখে সত্যিই অবাক হয়েছিলাম। কয়েক কোটি টাকা ব্যায়ে এতো বড়ো একটা প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ তো মুখের কথা নয় ! বীরভূম জেলায় বসুন্ধরা প্রেক্ষাগৃহের মতো একটি উন্নত মানের প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ কাঞ্চনদা বলেই সম্ভব হয়েছে। আমি নয়াপ্রজন্মে গ্রাম গুলোকে নিয়ে যে লেখা গুলো লিখছি তার বেশিরভাগ গ্রাম গুলোই কাঞ্চনদা আমাকে লেখার জন্য বলেছিলেন ।বীরভূমের প্রতিটি গ্রাম কাঞ্চনদার হাতের তালুর মতোই চেনা ।যে কোনো বিষয়ে ডিটেলস- এ লেখা পছন্দ করতেন কাঞ্চনদা। কাঞ্চনদা মৃত্যুর কিছুদিন আগে আমাকে স্বভাব কবি গণপতি ঘোষকে নিয়ে ডিটেলস -এ লেখার জন্য বলেছিলেন। কাঞ্চনদাকে বলেছিলাম গ্রাম গুলো নিয়ে লেখা কমপ্লিট হলেই গণপতি ঘোষকে নিয়ে লেখা পাঠাবো দাদা ।
কাঞ্চনদার What’s up status – এ ও উঠে আসতো বীরভূমের নানা প্রসঙ্গ। কিছুদিন আগে কাঞ্চনদা what’s up -এ পাঠিয়েছিলেন কোনো এক অনুষ্ঠানে বাসে কলকাতা যাচ্ছেন। সেখানে দুদিন থাকবেন। বীরভূমের সমস্ত কৃতী সন্তান যারা কর্মসূত্রে কলকাতায় থাকেন সকলের সাথে সেখানে দেখা হবে । তোমরাও কলকাতায় থাকলে চলে এসো। বীরভূম জেলাকে নিয়ে এবং বীরভূমের মানুষকে নিয়ে কাঞ্চনদার উৎসাহের কোনো সীমা পরিসীমা ছিল না। কাঞ্চনদার মতো প্রাণবন্ত মানুষ খুব কম জনই ছিলেন। বীরভূমের মা – মাটি – মানুষের প্রতি কাঞ্চনদার মতো এতখানি দরদ খুব কম মানুষের দেখেছি ।
কাঞ্চনদার মৃত্যুর খবরটা প্রথমে সোস্যাল মিডিয়ায় দেখে বিশ্বাস হয় নি। সিউড়ির এক অধ্যাপককে ফোন করে খবরটার সত্যতা যাচাই করি। কাঞ্চনদা আর নেই ভাবতেই চোখে জল আসে ।খুবই কষ্ট হয় । সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিয়ে হাজির হলাম কাঞ্চনদার বাড়িতে । কাঞ্চনদাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে গেলাম তাঁর বাড়িতে। আমি কাউকে ছোটো না করেও বলছি আমার জীবনে যতো আত্মীয় -স্বজন , বন্ধু-বান্ধবীকে হারিয়েছি তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুঃখ পেয়েছি কাঞ্চনদার মৃত্যুতে। সেদিন দুপুর বারোটা থেকে চারটে পর্যন্ত সিউড়ির রামকৃষ্ণ বিদ্যাপীঠ, সবুজের অভিযান ইত্যাদি জায়গায় এক সাংবাদিক বন্ধুর সাথে কাঞ্চনদার শেষ শব যাত্রায় ছিলাম।
এক দশকের বেশি সময় ধরে লেখালেখির জগতে আছি ।কিন্তু কাঞ্চনদার মতো এরকম নিঃস্বার্থ ভাবে কাজ করার মানুষ খুব কমই দেখেছি। কাঞ্চনদা আমৃত্যু সমাজের জন্য কাজ করে গেলেন। বর্তমানে সামাজিক অবক্ষয়ের সময়ে কাঞ্চনদার এভাবে চলে যাওয়াটা আমাদের সমাজে অনেকখানি শূন্যতা তৈরি করে দিলো।
আমরা আগেই উল্লেখ করেছি কাঞ্চনদার মন – প্রাণ সমস্তটাই জুড়ে ছিল বীরভূম জেলা। বীরভূমকে নিয়ে কাঞ্চনদা অনেক স্বপ্ন দেখতেন। তাঁর সেই স্বপ্নের ফসল সাপ্তাহিক নয়াপ্রজন্ম সংবাদপত্র থেকে শুরু করে সবুজের অভিযান, বসুন্ধরা মঞ্চ, নবজাতক ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান গুলো। কাঞ্চনদার পরিবারের কাছে এবং কাঞ্চনদার শুভানুধ্যায়ী সকল মানুষের কাছে আবেদন করবো কাঞ্চনদার অবর্তমানে কাঞ্চনদার স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানের কাজ গুলোকে নিঃস্বার্থ ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সকলে উদ্যোগ গ্রহণ করুন। মনে রাখবেন বীরভূমের মানুষ হয়ে কোনোভাবেই আপনি এই দায় তথা দায়িত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারেন না।এছাড়াও কাঞ্চনদার জীবদ্দশায় দেখা নয়াভূবন তৈরির মতো অপূর্ণ স্বপ্ন গুলোও তাঁর পরিবার এবং শুভানুধ্যায়ী মানুষজন পূর্ণতা দান করবেন এই আশা রাখি।

One thought on “যে শূন্যস্থান কখনো পূরণ হবার নয়

  1. অপুর্ব ‌‌‌‌‌লেখা । একেবারে সত্যি। তোমার লেখোনী টিতে তোমার মনের সচ্ছতা ধরা যায়। তুমি সঠিকভাবে চিনেছ।আসলে খুব কাছ থেকে দেখেছ তাই সাবলীল ভাবে তোমার অনুভূতির প্রকাশ করেছ বলে খুব ভাল লাগল।
    আশীর্বাদ করি জীবনে অনেক বড় হও। ভালো থেকো, সুস্হ থেকো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *