ধুলোর নির্জনে লেখা থাক নাসিমের নাম

চন্দন চট্টোপাধ্যায়ঃ

“রইল শোক, পরাজয়, জয়ের ইতিহাস/রইল স্মৃতি, বারুদ, অভাববোধ/রইল আড়াল, পর্দা, কালোপ্রেত…” –(একটি প্রাচীন দুর্গের ধংসাবশেষ)। শুধু রইল না সেই বাসমতী চালের অগ্রহায়ণ। ঝুমকোলতার টান ছিঁড়ে, বাংলা কবিতার তিন দশক কাঁপানো চাঁদ সদাগর পাড়ি দিলেন দীপাবলির আলোয় আলোয় এই আকাশে। অবশ্য তিনি না বলে যাননি। আমাদের পূর্ব প্রস্তুত করে ‘মধুচন্দ্রিমা’র অক্ষরে জানিয়ে দিয়েছিলেন আগেই—-“একটু পরেই বেরিয়ে পড়বো টিকিট বিহীন/যে কোনও স্টেশনে যদি লেখা দেখি ‘ভালোবাসা’—নেমে যাবো।” বোধহয় অবাধ্য কর্কটক্রান্তির টান অনুভব করেছিলেন তিনি। বুঝে গেছিলেন—“যাওয়া আসা সামান্যই পথ, তবু অজানা গল্পের শেষে অনিবার্য কোলাহল জাগে, বিষ্ফোরিত হয় দেহভার।” এই বিষ্ফোরণেই তো যাবতীয় সৃষ্টি। যেমন গ্রহ-নক্ষত্র, মাটির পৃথিবী। কিন্তু সৃষ্টিও কখনও কখনও বিষ্ফোরণ হয়। নাসিম-এ-আলমের কবিতা যেমন। সেই সৃষ্টির আলোয় বাঙ্ময় হয়ে থাকে নিমগ্ন জীবনবোধ। দ্রোহকাল উত্তীর্ণ সমূহ যাপনচিত্রে তাঁর কবিতা উঠে আসে রঙবেরঙের আবহে, লৌকিক মিথ নির্ভর অমল রোদ্দুর ধোয়া প্রান্ত-প্রহর হয়ে। অনন্ত জিরাফের মতো ঘাড় তুলে তিনি দেখে নেন, “দেশজ সীমানা, বিলুপ্ত নদীতীর, পুরোনো বাংলা গান, গমখেত, গামছা মাথায় কৃষক, সংসারের আশ্চর্য ক্ষুধা, মেয়েরা রুটি প্রস্তুত করছে”। আর এইসব সহ্য-আতিসয্যের টানাপোড়েনে আবিষ্কার করে ফেলেন জীবনের সারতত্ত্ব—“চিরস্থায়ী সুখী লোকালয় মনে হয় ভ্রমের বিকল্প।” তাই তিনি চিরস্থায়ী সুখের মোহ-জাল ছিঁড়ে এসে পড়তেন চরম সাধারণে। তাঁর প্রশ্নাতুর মায়াময় চোখ, খোলাহাট বন্ধুরঙা মন, স্বভাব বিনম্রতা ছিল তাঁর কবিতার মতোই সুললিত। তাঁর অমেয় শব্দচয়নের মতোই প্রাণবন্ত। এজন্যই তিনি তাঁর কবিতায় জীবনযাপন এবং যাপিত জীবনকল্পের এক আশ্চর্য বিনির্মানে গড়ে তুলতে পেরেছেন এক জৈবনিক আনুষঙ্গ। পাশাপাশি এসেছে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির সঙ্গত সমাধান। বেঁচে থাকার প্রযত্ন-সন্তরণ, আবার পরিমিত নিঃসঙ্গতাও; যা নির্জনতার ওম দিয়ে তাঁকে আপাদমস্তক করে তুলেছে হেমন্তের দূত। তিনি অধিগত করেছেন বাসমতীর উপাখ্যান। তাই কবিতার দুর্মর আখরে, ঋদ্ধ ভাবনায় এবং জ্যোৎস্নায়িত প্রয়োগ নৈপুণ্য নাসিম আলম হয়ে উঠেছিলেন কবিরুল ইসলাম পরবর্তী বীরভূমি কবিদের আত্মার সওদাগর। সেচবিভাগের কর্মী হবার সুবাদে সজল ধারায় আমৃত্যু ভালোবাসার উজান বইয়ে দিয়েছেন কাজে, ব্যবহারিক আচরণে, কলমেও। জলজ-অন্বেষণে দেখলেন-–“জলের ফেনার মধ্যে ঈষৎ লবণ/জলের নিম্নদেশে মাছ, শ্যাওলার সবুজ নিরীক্ষক/আরও নীচে ডুবুরিরা জানে/মুক্তো পড়ে আছে শত শত…” (চাঁদ সদাগর ফিরে আসবে)। ডুবুরির মতোই খুব সহজেই আত্মগত করে নিতে পারতেন অনুজতম কবির কবিতার পাশাপাশি পৌরানিক ও চর্যাপদী ধারাকেও। গ্রাম্য জীবনচর্যা মাখা রাঙামাটির বীরভূম এবং (এক শ্রেণির কবিদের ভাবনায় অভিজাত) সুদূর কোলকাতা কেন্দ্রিক নাগরিক কাব্যধারাও একাকার হয়ে গেছে তাঁর কলমে। সাত-সাতটি কাব্যগ্রন্থের জনক নাসিমের কলম কোনও গতানুগতিকতায় চালিত হয়নি কখনও। প্রেম, প্রকৃতি, পল্লীজীবন, মানবতাবাদ, সাম্প্রতিক রাজনীতি, সমাজবোধ, চাওয়া-পাওয়া, প্রতিবাদ–সবকিছুই তাঁর কবিতা জুড়ে ছিল ঋজু ও সপ্রতিভ। ‘চাঁদ সদাগর ফিরে আসবে’ গ্রন্থের ‘নদী’ কবিতায় সেই প্রাপ্তি ও অধিকারের বার্তা স্পষ্ট– “মাঝে মাঝে ফিরে আসে একই ভেলা, স্তব্ধ নদী, জাল/সঙ্গত মনে হয় তীরের খয়েরি চিল,/হেলে পড়া অশ্বত্থের ডাল/মিটিং মিছিলে ঝড় ওঠে, সভাঘর গমগম করে/কে পাবে নদীর প্রকৃত অধিকার।” এবং মাত্র ৫৭ বছরের ব্যবধান (১৯৬৫-২০২২) অনেক ‘যুদ্ধের পর’ তিনিই পেলেন সব– “পেয়েছি সম্পূর্ণ গৃহ, পেয়েছি চাওয়ার অতিরিক্ত…/যুদ্ধ ফেরৎ সব কাতরতা, রক্ত ও বারুদের ঘ্রাণ মুছে/অনন্ত মাটির কাছে বসে আছি।” আহা কী মাটির টান! ‘পেয়েছি সম্পূর্ণ গৃহ’ বুঝেও শেষমেশ ‘অনন্ত মাটির কাছে’ বসে থাকার মধ্যে নিহিত রয়েছে এক পার্থিব এবং শাশ্বত মোহ। এই মোহ’ই তো জীবনের পরম ও চরম মোক্ষ। উজ্জ্বল উদ্ধার। সেই মুক্তিতেই তো মানুষের বিহিত পরিনাম। নাসিমই বা তার ব্যতিক্রম হতে যাবেন কেন? তাই তিনি শোক বিমুখ, অশ্রুতে অবিশ্বাসী–“অশ্রু বিসর্জনে ইদানিং বিশ্বাস করি না/আমাদের শোক বড় বেশী লৌকিকতা পরায়ন।”—আরোগ্য (ধুলোর নির্জনে লেখা)। বরং আমাদের আশ্বস্ত করেছেন তিনি। ‘বন্ধু’ হয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছেন—“পাশাপাশি হেঁটে যাবো বহুদূর/শ্মশান অবধি/ভালোবাসো যদি।” সত্যিই আমরা যে ভালোবাসি! তাই কবি নাসিম-এ-আলম হাঁটছেন আমাদের পাশাপাশি। গত ২৪ অক্টোবর ২০২২ আইরিশ কলোনীতে সন্ধ্যা নেমে এলেও, কলমের আঁচড়ে তিনি প্রমাণ করে গেলেন, ময়ূর ক্লান্ত মানে বর্ষা শেষ নয়। অতএব আমরাও হেঁটে যাবো তাঁর কবিতার পায়ে পায়ে। কেবল শ্মশান অবধি নয়, যতদিন না চাঁদ সদাগর ফিরে আসবে, দ্রোহকাল কাটিয়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এআই শিখুন, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এগিয়ে যান!


এআই কোর্স: ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, শিক্ষক এবং ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য সম্পূর্ণ গাইড! Zed Age Infotech এর তরফ থেকে প্রথমবার বীরভূম জেলায়! আপনি কি ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, শিক্ষক নাকি ছাত্র/ছাত্রী? আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) আপনার কাজ এবং লেখাপড়াকে আরও সহজ এবং কার্যকর করতে পারে! Zed Age Infotech এর নতুন এআই কোর্সে যোগ দিন! বিশদ জানতে কল করুন 9474413998 নম্বরে অথবা নাম নথিভুক্ত করতে নীচের লিঙ্কে ক্লিক করুন।

This will close in 120 seconds