রত্নগর্ভা রাঢ়

উত্তম মণ্ডল

রাঢ়বঙ্গের লাল মাটিতে জন্মেছেন বহু ক্ষণজন্মা পুরুষ আর তাঁদের জন্ম দিয়েই রত্নগর্ভা হয়েছে রাঢ়ভূম। রাঢ়ভূমের প্রথম দার্শনিক মহর্ষি কপিল। গবেষকদের মতে, কপিল জন্মেছিলেন ঝালদার কাছাকাছি কোনো এক স্থানে এবং সিদ্ধিলাভ ঘটে রাঢ়ভূমের সমতটের শেষে বঙ্গোপসাগরের গঙ্গাসাগরে। জগতের মূল কারণগুলিকে সংখ‍্যাতত্ত্বের কাঠামোর মধ্যে বেঁধে ফেলতে চেয়েছিলেন মহর্ষি কপিল। এরপর মাটির মানুষের সঙ্গে অন্তরদেবতার মিলনের চেষ্টা করেছিলেন রাঢ়ভূমের আরেক দার্শনিক মহর্ষি পতঞ্জলি। বর্ধমান জেলার পাতুন গ্রামে তাঁর জন্ম হয়েছিল বলে জানা যায়।

আমাদের দেশের দুটি মহাকাব্য—রামায়ণ ও মহাভারতকে বাঙালির মতো করে বাংলা ভাষায় রূপ দেন রাঢ়ের দুই কৃতি সুসন্তান কৃত্তিবাস ওঝা ও কাশীরাম দাস। নদীয়া জেলার ফুলিয়া গ্রামের মানুষ কবি কৃত্তিবাস ওঝা। আর বর্ধমান জেলার সিদ্ধি (সিঙ্গি) গ্রামের মানুষ রাঢ়ীয় কায়স্থ এই কাশীরাম দাস। এছাড়া ভাগবতকে বাঙালির হৃদয়ে পৌঁছে দিয়ে বিখ্যাত হয়ে আছেন বর্ধমান জেলার কুলীন গ্রামের রাঢ়ীয় কায়স্থ মালাধর বসু। বাউলের মিষ্টিক ভাবের সঙ্গে মননের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন রাঢ়ভূমের লোচনদাস ঠাকুর, বৃন্দাবন দাস ঠাকুর, গোবিন্দ দাস ঠাকুরের মতো বৈষ্ণব কবিরা। আর রাঢ়ের মানুষকে আনন্দের জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন বীরভূমের নানুরের দ্বিজ চণ্ডীদাস, বর্ধমানের দীন চণ্ডীদাস ও বাঁকুড়া জেলার ছাতনা গ্রামের মানুষ বড়ু চণ্ডীদাস।

বাংলায় বৈষ্ণব কাব‍্যের পাশাপাশি তৈরি হয়েছে মঙ্গল কাব্যের যুগ। মানুষের সঙ্গে দেবতার দেখা-সাক্ষাৎ ঘটেছে মঙ্গলকাব‍্যে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন “ধর্মমঙ্গল” কাব‍্যের রচয়িতা বর্ধমানের ঘনারাম চক্রবর্তী, বর্ধমান জেলার দামুন‍্যা গ্রামের “চণ্ডীমঙ্গল” কাব‍্যের রচয়িতা কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ও ভূরসুটের পেঁড়ো-বসন্তপুর গ্রামের “অন্নদামঙ্গল” কাব‍্যের রচয়িতা রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রায়। রাঢ়বঙ্গের রাঙামাটির আরেক সুসন্তান “গীতগোবিন্দ” কাব‍্যের রচয়িতা প্রাচীন গোপভূম রাজ‍্য এবং বর্তমানে বীরভূম জেলার ইলামবাজার থানার অজয় নদের তীরে কেন্দুবিল্ব গ্রামের ভক্তকবি জয়দেব গোস্বামী, যাঁর কান্তকোমল পদ আস্বাদন করে তৃপ্ত হতেন স্বয়ং শ্রীচৈতন্য। অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র ছিলেন রাঢ়ভূমের সু-সন্তান। আর জন্মসূত্রে না হলেও বংশধারা সূত্রে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও “মধুকবি” মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন রাঢ়ী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতৃপুরুষের আদি শিকড় ছিল বর্ধমান জেলায়। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ছন্দের যাদুকর কবি সত‍্যেন্দ্রনাথ দত্ত—দু’জনেই ছিলেন রাঢ়বঙ্গের বর্ধমান জেলার মানুষ। সাহিত্যিক “পরশুরাম” ছদ্মনামের আড়ালে রাজশেখর বসু ছিলেন বর্ধমান জেলার ব্রাহ্মণপাড়া গ্রামের মানুষ। আর এই রাঢ়ভূমের সুসন্তান ছিলেন প্রখ্যাত ভাষাচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়। শুভঙ্করী গণিতের অন‍্যতম পুরোধা পুরুষ ছিলেন বাঁকুড়ার রাঢ়ী কায়স্থ শুভঙ্কর দাশ। দণ্ডভুক্তি অর্থাৎ দক্ষিণ রাঢ়ের অর্থাৎ মেদিনীপুর অঞ্চলের রাজা শালিবাহনের উৎসাহে রাঢ়বঙ্গের আরেক সুসন্তান জয়ন্ত পাণিগ্রাহী নতুনভাবে সৌর বৎসর গণনা প্রবর্তন করেন। আগে বাংলা বৎসরের প্রথম মাস ছিল মার্গশীর্ষ অর্থাৎ অঘ্রাণ মাস থেকে। পরে বাংলা বৎসর গণনা শুরু হয় বৈশাখ থেকে। “সাল” শব্দটা ফারসি, তবে বাংলার “শাল” শব্দটির উৎস হচ্ছে দণ্ডভুক্তির রাজা শালিবাহনের নাম।

কেউ কেউ বলেন, খনার বচনের খনা বা ক্ষণা ছিলেন রাঢ়বঙ্গের সেনভূম পরগনার বাঁকুড়ার রাঢ়ী বৈদ‍্যকুল বংশোদ্ভূতা। আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতিষ্ঠাতা মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসু ছিলেন রাঢ়ভূমের বর্ধমানের মানুষ। আর যাঁর হাতে রাসবিহারী বসু তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজের দায়িত্বভার তুলে দিয়েছিলেন, সেই নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন বংশধারা সূত্রে রাঢ়ী। জন্মসূত্রে না হলেও বংশধারা সূত্রে রাঢ়ী ছিলেন বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, সত‍্যেন্দ্রনাথ বসু, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ। হুগলি জেলার গোঘাট থানার রাধানগর গ্রামের মানুষ ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। তখন অবশ্য গোঘাট থানা বর্ধমান জেলার অন্তর্গত ছিল। আর বীরসিংহের সিংহশিশু বীর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ‍্যাসাগর ছিলেন মেদিনীপুরের মানুষ। বিদ‍্যাসাগরের জন্মস্থান বীরসিংহগ্রাম তখন ছিল হুগলি জেলার অধীন। পরে তা মেদিনীপুরের নবগঠিত ঘাটাল মহকুমার অন্তর্ভুক্ত হয়।

অবতার বরিষ্ঠ শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস ছিলেন হুগলি জেলার আরামবাগ মহকুমার কামারপুকুর গ্রামের মানুষ। তাঁর শিষ‍্য যুগনায়ক স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন বর্ধমান জেলার কালনা মহকুমার দত্তদেড়েটন গ্রামের রাঢ়ী কায়স্থ বংশোদ্ভূত। বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ থেকে ঋষি অরবিন্দ ছিলেন হুগলি জেলার কোন্নগরের রাঢ়ী কায়স্থ। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন, অক্ষয় কুমার দত্ত জন্মসূত্রে না হলেও বংশধারা সূত্রে ছিলেন রাঢ়ী। সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন, নিত‍্যানন্দ প্রভু, কৃষ্ণদাস কবিরাজ ছিলেন রাঢ়বঙ্গের মানুষ। বীরভূমের একচক্রা গ্রামে নিত‍্যানন্দ এবং বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমার কেতুগ্রাম থানার ঝামটপুর গ্রামের ভূমিপুত্র ছিলেন কৃষ্ণদাস কবিরাজ। এছাড়া গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আচার্য নন্দলাল বসু ছিলেন বংশধারা সূত্রে রাঢ়ী। শিল্পী যামিনী রায়, রামকিঙ্কর বেজ ছিলেন রাঢ়বঙ্গের বাঁকুড়া জেলার কৃতি সন্তান। কেউ কেউ বলেন, মহাকবি কালিদাস ছিলেন দক্ষিণ রাঢ়ভূমের কাঁথি অঞ্চলের বাসিন্দা। কালিদাসের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলের বর্ণনার সঙ্গে প্রায় হুবহু মিলে যায় কাঁথির সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলের বর্ণনা। এভাবেই মহর্ষি কপিল থেকে শুরু করে বহু বরেণ্য মানুষের জন্মভূমি ও কর্মভূমি হিসেবে পরিচিত হয়েছে রত্নগর্ভা রাঢ়।

5 thoughts on “রত্নগর্ভা রাঢ়

  1. এই লেখাটির ১০০% শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকারের “বাঙলা ও বাঙালী” নামক গ্রন্থের হুবহু মিলে গেছে। শ্রদ্ধেয় উত্তম বাবু সংক্ষিপ্ত আকারে কপি করেছেন। পাঠকবর্গকে অনুরোধ রত্মগর্ভা রাঢ়ের অলিখিত ইতিহাস জানতে শ্রী সরকারের লেখা “বাঙলা ও বাঙালী” অবশ্যই পড়ুন। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি বাংলা ভাষাবিজ্ঞানের ওপর লিখিত গ্রন্থগুলিতে এমন অজানা দিক রয়েছে যার ওপর অনেকেই গবেষণা করছেন।

  2. আপনার এই লেখার সূত্র কি? এই তথ্য সূত্র তো শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকারের লেখা “সভ্যতার আদি বিন্দু রাঢ়” আর বাংলা ও বাঙালী” দুটি বই থেকে নেওয়া। তাই তথ্য সূত্র উল্লেখ করলে ভালো হত। আপনার এই লেখাও পূর্ণতা পেত।

Leave a Reply to Anindya Sundar Datta Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এআই শিখুন, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এগিয়ে যান!


এআই কোর্স: ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, শিক্ষক এবং ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য সম্পূর্ণ গাইড! Zed Age Infotech এর তরফ থেকে প্রথমবার বীরভূম জেলায়! আপনি কি ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, শিক্ষক নাকি ছাত্র/ছাত্রী? আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) আপনার কাজ এবং লেখাপড়াকে আরও সহজ এবং কার্যকর করতে পারে! Zed Age Infotech এর নতুন এআই কোর্সে যোগ দিন! বিশদ জানতে কল করুন 9474413998 নম্বরে অথবা নাম নথিভুক্ত করতে নীচের লিঙ্কে ক্লিক করুন।

This will close in 120 seconds