বীরভূমে প্রস্তরময় দুর্গা

ড. আদিত‍্য মুখোপাধ‍্যায়ঃ

বীরভূম জেলায় তথাগত বুদ্ধের মূর্তি আজ আর কোথাও নেই, বুদ্ধের পুজোও হয় না। তথাপি হিউয়েন সাঙ যখন  এই ভূমির উপর দিয়ে তাম্রলিপ্ত বন্দরে গিয়েছিলেন, তখন তিনি বেশ কয়েকটি বৌদ্ধস্তুপ এখানে দেখেছিলেন। প্রচুর সংখ্যক বৌদ্ধ তখন এখানে বসবাস করতেন। বৌদ্ধদের মূর্তি তৈরির কারখানাও এই বীরভূমে তখন ছিল। লোহাপুরের কাছে বারা গ্রাম এবং বোলপুরের কাছে দেউলি গ্রাম এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। দেউলির দক্ষিণ প্রান্তেই অজয় নদ, সেখানে বহু সময় বহু মূর্তি পাওয়া গেছে। বহু মূর্তি উদ্ধার হয়েছে বারা গ্রামের ধারেপাশে এবং গামীরার বুক থেকে। আজকে বীরভূমে একঘরও বৌদ্ধ নেই। অথচ রোঙ্গাইপুর মাঠপলশা অঞ্চল থেকেই নাকি চর্যাকার লুইপাদ তান্ত্রিকদের উৎপাতে তিব্বত অঞ্চলে চলে যেতে বাধ‍্য হন। আবার বৌদ্ধদের সহজযান চক্রযান প্রভৃতির ভিত্তিভূমিতেই দাঁড়িয়ে আছে তন্ত্র ও তান্ত্রিকতা। ব্রাহ্মণ‍্যবাদও বৌদ্ধদের বিরোধীতা করেছে। তথাকথিত নীচুতলার বৌদ্ধ ও হিন্দুরাই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে বেশি।

সবচেয়ে বড়োকথা বীরভূমের অন‍্যতম শ্রেষ্ঠ সিদ্ধপীঠ তারাপীঠের দেবীই শিলামূর্তি এবং তিনি বৌদ্ধদেবী।”বশিষ্ঠারাধিতা তারা/যত্র তারা শীলাময়ী”। এখানে একটি গল্প আছে, প্রথম জীবনে হিন্দু ব্রাহ্মণ তান্ত্রিক বশিষ্ঠ নাকি ফুল-ফল-বেলপাতা নিয়ে দুশ্চর সাধনা করেও সিদ্ধিলাভ করতে পারেননি। চিনাচার সাধন পদ্ধতি তথা মদ-মাংস-মৈথুন দিয়ে তথা পঞ্চ’মকার সাধনাকে তিনি পরিহাস করেছিলেন। আর পরের জীবনে বেদগর্ভের ওই সন্তান বশিষ্ঠই পঞ্চ’মকার সাধনা করেই তারাসিদ্ধ হন। মাতৃস্তনপানরত শিবকে তিনি সেদিন চোখ খুলতেই পেয়েছিলেন উত্তরবাহিনী দ্বারকার কূলে তারাপীঠ মহাশ্মশানের মাটিতে।

আসলে সিদ্ধ নাগার্জুনের তিব্বত অঞ্চল থেকে তারামূর্তি নিয়ে আসার কথা সরিয়ে রেখে বশিষ্ঠের কথা জুড়ে দেওয়া হয়। আর্য নাগার্জুন সম্ভবত সপ্তম শতাব্দীতেই বাংলার বুকে তারাসাধনার শুরু করেন। হিন্দু তারাসাধনার যুগে তাঁকে বর্জন করা হয়। যুক্ত করা হয় বশিষ্ঠের কাহিনি।

আর ডি ব‍্যানার্জি তাঁর ‘এজেস অফ দি পাল’ বইতে বলেছেন “বাংলা দেশে প্রথম তারা মূর্তি স্থাপন করেন রাম পাল”। বৌদ্ধদের মহাচীন তারাই তারাপীঠে হিন্দু তারায় পরিণত হয়েছেন। সামান‍্য দূরে, বর্তমানে মলুটির মৌলিক্ষা দেবীও বৌদ্ধদেবী পাণ্ডারা। একই বৌদ্ধ উৎপত্তির কারণে তাঁদের দুই বোন বলা হয়। বলা দরকার মা তারা, মা মৌলিক্ষা, দুর্গাপুজোর চারদিনই মা দুর্গা-ভগবতী হিসেবে আপনার নিজস্ব মূর্তিতেই পুজো গ্রহণ করেন। ওই চারদিন তাঁরাই দুর্গা।

বাংলায় হাজার বারশো বছরের প্রাচীন পাল-সেন-কুষাণ যুগের প্রস্তর নির্মিত ‘মহিষমর্দিনী’র সন্ধান পাওয়া গেছে। বীরভূমের বারা গ্রামেও ছিল অষ্টভুজা ‘ভুবনেশ্বরী’, দেউলিতে লক্ষণ সেন প্রতিষ্ঠিত ‘দশভুজা’ খেঁদা পার্বতী, কনকপুরে ‘অপরাজিতা’, বক্রেশ্বরে অষ্টভুজা পীঠদেবী ‘মহিষমর্দিনী’, জাজিগ্রামে ‘মহিষমর্দিনী’, ভাটড়ায় ‘ভবানী’, দেবীপুরের বৌদ্ধ দেবী ‘সুম্ভেশ্বরী’, মোনায়ের ‘মণিকর্ণিকা’ বা ‘মোনাইচণ্ডী’, বাঁশলৈয়ের ‘কনিক্ষা মা’ ছাড়াও পঞ্চ সতীপীঠের পীঠদেবী সবাই মহাপুজোর চারদিন সর্বত্রই দুর্গা-ভগবতী রূপেই পূজিত হন। এগুলির সবই প্রস্তর নির্মিত মূর্তি। অনেকক্ষেত্রে এই প্রস্তরমূর্তি থাকার কারণে ওইসব গ্রামে মৃত্তিকামূর্তির চল নেই। স্থানীয়রা বলেন এই দেবীকেই তো দুর্গা হিসেবে চারদিন পুজো করা হয়, তাই গ্রামে মৃত্তিকামূর্তি বানানো নিষেধ আছে। সবক্ষেত্রে এদাবী এখন আর মানা হয় না, বারোয়ারি পুজো হচ্ছে দু-এক জায়গায়।

বছর পঞ্চাশ আগেও বীরভূম জেলায় কয়েকটি বৌদ্ধস্তুপ ছিল, দেখেছেন অনেকেই। আজ আর একটিও নেই। সংরক্ষণ করা যায়নি কোনো কিছুই। ডেউচা, মাড়গ্রাম, মোনাই গ্রামের বৌদ্ধ স্তুপগুলি চাড়িয়ে গুড়িয়ে দেওয়া হল সবার চোখর সামনেই!

ভাটরা-ভবানীপুরের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে সাহেবগঞ্জ লুপ লাইনের রেলপথ। রেললাইনের ওপারেই ধানক্ষেতের মাঝখানে “ভদ্রকালীর থান”, ঘাটবাঁধান পুকুর, মন্দির-মহলের ধ্বংসাবশেষ। বোঝা যায় এক সময় এখানে সম্পন্ন গ্রাম ছিল। ছিল গ্রামদেবী ভদ্রকালী। ভদ্রকালী ভদ্রসেনের অষ্টভুজা মহিষমর্দিনী দেবী। পরে এই দেবী নশীপুর রাজের আয়ত্বাধীন হয়। বর্তমানে এই দেবীর পুজো পার্বণ করেন ভবানীপুরের উত্তম চ‍্যাটার্জিরা। দেবীর রাজদত্ত প্রচুর সম্পত্তি ছিল। এখনও যা আছে তাতেই পুজো চলে। শিবরাত্রির দিন ভদ্রকালী চত্বরে মেলা বসে। কালো পাথরের দেবীকে দুষ্কৃতীরা খণ্ডবিখণ্ড করে দিয়ে গেছে। এখন তাকেই জোড়াতালি দিয়ে জুড়ে রাখা হয়েছে। দুর্গাপুজোর চারদিনই মহাসমারহে পুজো হয়।

বীরভূমে পাথরের মহিষমর্দিনী দুর্গা খুব বেশি নেই। মাত্রই কটি পাওয়া গেছে। বক্রেশ্বরে আচার্য বাড়িতে আছেন সুখ‍্যাত আঠারো হাতের পীঠদেবী দুর্গা। মন্দিরে যে পিতলের মহিষমর্দিনী দেখা যায়, তা নাকি খাঁকিবাবা এনে বসিয়েছেন। দেউলির অপরূপ এবং সুউচ্চ খেঁদা পার্বতীর জন‍্য অবশ‍্যই এ জেলা গর্ব করতে পারে। এমন মূর্তি বাংলায় বিরল। বৌদ্ধপ্রভাবের ফলেই বাংলার জাতীয় লোক দেবতা ধরমের সঙ্গেও কোথাও কোথাও মিলে গেছেন মহাদেব। তাই বীরভূমের বহু জায়গাতেই বুদ্ধের জন্মদিন বৈশাখী বুদ্ধপূর্ণিমায় পুজো হয় ধর্মরাজ ধরমঠাকুরের। চণ্ডী-দুর্গা-ভগবতী-পার্বতী, এমনকী দশ মহাবিদ‍্যার দেবী সবই দুর্গার রূপ এবং পরবর্তীতে তিনিই দেবাদিদেব মহাদেবের স্ত্রী। বলা বাহুল্য, লোকায়ত চণ্ডী আর পৌরাণিক ভগবতীও মিলেমিশে এক হয়ে গেছেন এই জঙ্গলভূম বীরভূমে। তাই শুধু পাথর-কাঠ-মাটিই নন, দুর্গা এবং শিব হয়ে উঠেছেন বাংলার আপনজন। যদিও এ জেলায় সব ক্ষেত্রেই পাওয়া যায় লোকায়ত-পৌরাণিক এবং বৌদ্ধ সংস্কৃতির স্পষ্ট সংমিশ্রণ, মেলবন্ধন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *