দুর্গাপুজোর তিনদিন মেয়েদের হেঁসেল বন্ধ থাকে রাজনগরের রুহিদা গ্রামে

উত্তম মণ্ডলঃ

—কি মাছ দেবো ?
—রুই দে—
একসময় প্রচুর রুই মাছ পাওয়া যেতো আর তাই গাঁয়ের নাম হয়ে যায় “রুই দে।” আর তা থেকে বর্তমানে কাগজ-কলমে এ গাঁয়ের নাম “রুহিদা।” প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাথায় এই “রুহিদা” নামটিই জ্বল জ্বল করছে।
জেলা বীরভূমের প্রান্তিক অঞ্চল রাজনগর থানার এক প্রত‍্যন্ত গ্রাম এই রুহিদা। অনতিদূরেই বয়ে চলেছে নদী সিদ্ধেশ্বরী। আর তার পেট থেকে বেরিয়ে আসছে লরি লরি সোনার দানা, “বালি।” বালি নিয়ে করেকম্মে খাচ্ছে বহু লোক। বালি সরিয়ে এবার পুজোর কথায় আসি।
গাঁয়ের অঘোষিত মোড়ল রণজিৎ চৌধুরী আমার সহপাঠী। রণজিৎ পুজোর বহু আগেই বলে রেখেছে, পুজো দেখতে আসতে হবে তাদের গাঁয়ে। অত এব সপরিবারে যাত্রা রুহিদা গ্রামে, দু’চাকায় চেপে। সঙ্গে বন্ধু আবৃত্তিকার প্রভাত দত্ত ও তাঁর “পরিবার” মমতা।
ছোট্ট গ্রাম রুহিদা, ২৮০ জন ভোটার। বেশির ভাগ সদগোপ “চৌধুরী”, অন‍্যান‍্যদের মধ্যে খয়রা আছে, আরও অন্য জাতির লোক আছে।
আগে গাঁয়ে একটিই দুর্গাপুজো হতো। গাঁ এখন দু’ভাগ। পুজো হয় দুটো। একটা সরকারি অনুদান পায়, আরেকটি পায় না। নিজেরা চাঁদা দিয়ে পুজো করে।
রণজিৎ চৌধুরীদের পরিচালিত পুজো সরকারি অনুদান পেয়েছে। রণজিতদের গোটা পরিবারের সদস্যরা এই পুজোর সময় একসঙ্গে এক হাঁড়িতে খান। বাকি সময় যে যার কর্মক্ষেত্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকেন। বিরাট যৌথ পরিবার ছিল একসময় তাদের। টিনের তিনতলা পেল্লাই বাড়ি তার উদাহরণ। পাশেই গোয়াল। এখন গোরু শূন্য। জলসেচের দুনি টাঙানো রয়েছে গোয়ালের মাচায়। এই প্রজন্ম দুনি কি জিনিস জানেই না। দুনি মানে লোহার তৈরি নৌকো। পুকুরে পা দিয়ে ডুবিয়ে জল তুলে জমিতে সেচের জল দেওয়া হতো। এখন যাদুঘরে রাখার জিনিস!
অন‍্য পুজোটি সরকারি অনুদান ছাড়াই আয়োজিত হচ্ছে। অনুদান পাননি বলে খেদ নেই। আগে অবশ্য অনুদান পেয়েছেন। তারপর কি যে হলো! গ্রাম‍্য বিবাদের জেরে মা দুর্গাও দু’ভাগ হয়ে গেলেন। মন্দির তৈরিতেও এলো বিস্তর বাধা। তাই মন্দিরের কাজ এখনো আটকে রয়েছে। এই পুজোর সঙ্গে যুক্ত ব‍্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন প্রাক্তন শিক্ষক জয়কৃষ্ণ চৌধুরী, সুনীল চৌধুরী, বিকাশ চৌধুরীরা। স্টেট ব‍্যাঙ্কের কর্মী বিকাশ। পুজোয় টাকা লাগলে বিকাশ হচ্ছেন মুশকিল আসান। অমায়িক ব‍্যবহার। মাস্টার মশাই জয়কৃষ্ণ চৌধুরী আজও স্বপ্ন দেখেন, দেবী দুর্গতিনাশিনী তাদের গ্রামকে আবার জোড়া লাগাবেন। এই পরিবারের ক্ষুদে সদস্য অর্ঘ্য বর্তমানে সিউড়ি জেলা স্কুলের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র।
জয়কৃষ্ণবাবু ছিলেন সিউড়ির “সোনাদা” মানে কংগ্রেস নেতা সুনীতি চট্টরাজের বন্ধু। ছেলের বৌ দুবরাজপুর থানার পলাশবন গ্রামের মেয়ে। বাড়িতে যত্ন করে বানিয়েছেন ঘিয়ে ভাজা মিষ্টি, বেলের মোরব্বা। পুরোনো সাধারণ বাড়ি, দেখেই মনে হয়, “নীড় ছোট ক্ষতি নেই, আকাশ তো বড়ো।” অতিথি আপ‍্যায়নে অত‍্যন্ত আন্তরিক তাঁর পরিবার। গ্রামেই যে এখনো আতিথেয়তা টিকে রয়েছে, সে শুধুমাত্র এই জয়কৃষ্ণবাবুর মতো মানুষ আছেন বলে।
তবে মা দুর্গা দু’ভাগ হলেও একটি জায়গায় দু’দলের ভীষণ মিল আর তা হলো, পুজোর তিনদিন অর্থাৎ সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী গ্রামের বাড়ির মেয়ে বৌদের বিশ্রাম। এই তিনটে দিন সবাই পুজোর ভোগেই ক্ষুধা নিবারণ করবেন। হেঁসেল বন্ধ। আর এই উদাহরণটা অন‍্যান‍্য গ্রামের পুজো কমিটির লোকজন অনুসরণ করতেই পারেন। বিশ্রাম দিতে পারেন বাড়ির মেয়েদের! ভেবে দেখবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *