তীর্থকুমার পৈতণ্ডীঃ
ভারত গ্রাম প্রধান দেশ। গ্রামীন ভারতের অর্থনীতির মূল ভিত্তি কৃষি। যুগে যুগে তাই কৃষিদেবতাকে সন্তুষ্ট রাখতে মানুষের কতই না প্রচেষ্টা। আজও গ্রামবাংলায় ধানের দেবী ধনের দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা হয় ভক্তি সহকারে। শুধুমাত্র কোজাগরী কিম্বা প্রতি বৃহষ্পতিবার লক্ষ্মীপুজো নয় এর বাইরেও গ্রামের মানুষ লক্ষ্মীর আরাধনা করে কৃষিদেবীরূপে। সেই পঞ্চলক্ষ্মী পুজো এখনো গ্রামে গ্রামে প্রচলিত। আশ্বিন মাসের সংক্রান্তি ডাক সংক্রান্তি নামে পরিচিত। এইদিন বড়ান ধানের মাঠে পুজো হয়। অনেকে বলে ষাটপুজো। ধান গাছের নীচে ফুল, বেলপাতা, বুটকলাই ভিজে, তেল হলুদ দিয়ে লক্ষ্মীর আরাধনা হয়। ধান গাছে মাখিয়ে দেওয়া হয় হলুদ বাঁটা, সিন্দুর। নীচে দেওয়া হয় হরিতকি, বাঁশপাতা, আঁতপ, বাতাসা। তুলে দেওয়া হয় ধানের শিকড়। ভালো ফসলের কামনায় এই পুজো। ঠিক একমাস পর কার্ত্তিক সংক্রান্তি মুঠ সংক্রান্তি। খুব সকালে স্নান করে চাষী মাঠে যায়। সঙ্গে নিয়ে যায় কাপড়, কাস্তে, সিন্দুর, আঁতপ, বাতাসা আর হরিতকি। বড়ান ধানের গোড়ায় ঈশান কোণে ছড়িয়ে দেওয়া হয় আঁতপ। ধানের গাছে দেওয়া হয় সিন্দুর। গোড়ায় দেওয়া হয় হরিতকি, বাতাসা। তারপর প্রণাম করে কেটে নেওয়া হয় এক মুঠি ধান। সেই ধান কাপড়ে জড়িয়ে মাথায় করে বাড়ি নিয়ে আসে চাষী। চাষী গিন্নি দরজায় পা ধুইয়ে দেয়। জলধারা দিয়ে সেই মুঠলক্ষ্মীকে ধূপদীপ দেখিয়ে শাঁখ বাজিয়ে ঘরে প্রবেশ করানো হয়। উঠান ভরে ওঠে আলপনায়। সেই মুঠো ধানেই হয় পৌষলক্ষ্মী, খড়ে হয় চাওড়ি বাঁওড়ি। মুঠলক্ষ্মীর ঠিক একমাস পর ইতুলক্ষ্মী। ইতুলক্ষ্মী মূলত মেয়েদের পুজো। অঘ্রাণের সংক্রান্তি অর্থাৎ শেষদিনে তুলসীতলায় হয় এই ইতুপুজো। কলমীলতা, খিঁচুড়িলতার বিড়ের উপর জল ভর্তি ঘট বসানো হয়। ঘটের উপর ঠিক তেরোটি বড়ান ধানের শিষ, সিন্দুর শোভা পায়। পুজোতে কেউ দেয় দুধ চিড়ে ফলের ভোগ আবার কেউ দেয় আষকে পিঠের ভোগ। ইতুলক্ষ্মীর পুজো করে তবেই বাড়ির মেয়েরা খাবার মুখে দেয়। পৌষসংক্রান্তির আগের দিন হয় লক্ষ্মীপুজো। মুঠের ধান দিয়ে পাতা হয় লক্ষ্মী। বেতের ডালাতে ধানের উপর বসানো হয় কড়ি। এই কড়ি লক্ষ্মী রূপে পুজো পায়। বাঙালীর ঘরে ঘরে হয় পিঠেপরব, হয় টুসু পুজো। আলপনায় ভরে উঠে ঘরের নিকানো উঠোন। খুব ভোরে উঠে চাষীগিন্নি “এসো পৌষ যেও না” আহ্বানে পৌষমাসকে চলে না যাওয়ার প্রার্থনা জানায়। তারপর নদী পুকুরে মকর স্নান করে ভাসিয়ে দেওয়া হবে মুঠোলক্ষ্মীর শুকনো খড়, যার গ্রাম্য নাম বাঁউড়ী। চৈত্রসংক্রান্তির আগের দিন নীল লক্ষ্মী। এটাই বছরের শেষ লক্ষ্মী পুজো। এবারেও বেতের ডালিতে কড়ি বসিয়ে পুজো হয়। এই পঞ্চলক্ষ্মী ছাড়াও ভাদ্র আশ্বিনে শুক্লাদ্বাদশীতে হয় ইন্দলক্ষ্মী আর অঘ্রাণে হয় দাওন লক্ষ্মী। মাঠের শেষ ধানের আঁটি মাথায় করে নিয়ে আসে চাষী। গরুর পায়ে জল, কপালে সিন্দুর আর শিঙে তেল মাখানো হয়। দাওন উপলক্ষ্যে কৃষককে চালের রুটি আর পায়েস খাওয়ানো হয়। দিন বদলে গেছে। গ্রামের মানুষ আজ শহরমুখী। একালের মেয়েরা নতুন করে আর এসব করতে উৎসাহ দেখায় না। যৌথ পরিবার ভেঙে গেছে তাই এসব গ্রাম্য ফসল উতসব আর কতদিন টিকে থাকতে পারে তা ভবিষ্যতই বলবে।