উত্তম মণ্ডলঃ
বীরভূমের হৃদ্ মাঝারে উড়িষ্যা বা বলা যায়, বীরভূম স্থাপত্যে উড়িষ্যা। আসছি সে প্রসঙ্গে।
বীরভূমের সঙ্গে উড়িষ্যার সম্পর্ক বেশ প্রাচীন।পরবর্তীকালে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা মিলে তৈরি হয় “সুবা বাংলা।” বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌল্লাকে আমরা এই সুবা বাংলার নবাব পদে দেখি। তার বহু আগে থেকেই বীরভূমের বিভিন্ন জায়গায় এখনো জেগে রয়েছে এক টুকরো করে উড়িষ্যা স্মৃতি। বীরভূমের বেশ কিছু স্থাপত্য ও ভাস্কর্যে রয়েছে উড়িষ্যাদেশীয় শিল্প রীতির প্রভাব। এরকমই একটি স্থাপত্য হলো জেলা বীরভূমের একদা রাজধানী এবং বর্তমানে ঝাড়খণ্ড লাগোয়া এ জেলার প্রান্তিক অঞ্চল রাজনগরে উড়িষ্যারাজের বিজয়স্তম্ভ। এককথায় অনাদরে এবং অবহেলায় ক্রমশ ধ্বংসের পথে উড়িষ্যারাজ প্রথম নরসিংহদেবের রাজনগর বিজয়ের এই স্মারকস্তম্ভ। সময়কাল ১২৪৪ খৃষ্টাব্দ। দিল্লির মসনদে তখন সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন, আর লক্ষ্মণাবতীর শাসক তুগরল তুগান খান। তুগরলবাহিনী বার বার উড়িষ্যা আক্রমণের চেষ্টা করতো। তাই উড়িষ্যারাজ প্রথম নরসিংহদেব ১২৪৪ খৃষ্টাব্দে , ঐতিহাসিক মিনহাজ উদ্দিনের “তবকৎ-ই-নাসিরি” অনুসারে ৬৪২ হিজরি সনের শওয়াল মাসের ১৩ তারিখ মঙ্গলবার লক্ষ্মণাবতী জয়ের জন্য বের হোন এবং পথে বীরভূমের তদানীন্তন রাজধানী রাজনগরের শাসক ফকর-উল-মুলুক করিম উদ্দিন ল্যাংঘ্রিকে পরাজিত ও নিহত করে দখল করে নেন রাজনগর। একদা জেলা বীরভূমের রাজধানী এবং বর্তমানে জেলার প্রান্তিক অঞ্চল রাজনগরের হাটতলায় কালীদহ পুকুরের মাঝখানে এখনো জেগে রয়েছে সেই ঐতিহাসিক স্মৃতি সৌধের ধ্বংসাবশেষ।
উড়িষ্যার বহু আগেও মহাকবি কালিদাসের “রঘুবংশ” কাব্যে আমরা জলের মাঝে এই ধরনের বিজয়স্তম্ভ নির্মাণের খবর পাচ্ছি। সেখানে দেখা যাচ্ছে, সুহ্মদেশ জয় করার পর মহারাজ রঘু বঙ্গ জয় করেন এবং গঙ্গা নদীর মাঝখানে নিজের বিজয় পতাকা প্রোথিত করেন। অনেকেই এটিকে রাজনগরের বীর রাজার তৈরি কালীমন্দির বলে মনে করেন, কিন্তু জলের মাঝখানে সৌধ নির্মাণ হলো একটি উড়িষ্যা দেশীয় স্থাপত্য রীতি। তাই বলা যায়, এটি আসলে উড়িষ্যারাজ প্রথম নরসিংহদেবের রাজনগর বিজয়ের স্মারকস্তম্ভ। বীর রাজার কালীমন্দির ছিল কালীদহ পুকুরের উত্তর পাড়ে। প্রাকৃতিক কারণে তা নিশ্চিহ্ন। তবে এখনো এলাকার ধীবররা এই কালীদহে মাছ ধরতে নামার আগে উত্তর দিকে মুখ করে মা কালীর উদ্দেশ্যে প্রণাম করে। এছাড়া এই উত্তর দিকেই একটি সিমেন্টের বেদিতে পুজো হয় মা কালীর। এসব কারণে কালীদহের উত্তর দিকেই যে কালীমন্দির ছিল, তা প্রমাণ হয়েই যায়। কালীদহের উত্তর দিকেই বর্ষার সময় অতিরিক্ত জল বেরিয়ে যাবার পথ এবং এই পথেই সে জল বেরিয়ে গিয়ে পাশে কুশকর্ণী নদীতে পড়তো। কালীদহের উত্তর দিকের নিচু অংশ এখনো তার সাক্ষী। বর্তমানে এই খাত ধান জমি এবং গ্রীষ্মকালেও একমাত্র এই এলাকার ভেজা মাটিতে ধান চাষ হয়ে থাকে। যাই হোক, কালীদহের মাঝখানে উড়িষ্যারাজ প্রথম নরসিংহদেবের ১২৪৪ খ্রিস্টাব্দে রাজনগর বিজয়ের স্মারকস্তম্ভ এখন অবহেলা আর অনাদরে ধ্বংসের পথে। জেলার এই গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরি হলেও এখনো পর্যন্ত নেই কোনো উদ্যোগ, যা একই সঙ্গে উদ্বেগের এবং ভাবনার। শুরু রাজনগরেই নয়, বীরভূমের অন্যান্য অংশেও, বিশেষ করে, শৈবক্ষেত্র বক্রেশ্বর শিব মন্দিরের গায়ে প্রাচ্যবিদ্যার্ণব নগেন্দ্রনাথ বসু “নরসিংহ” কথাটি পাঠোদ্ধার করে গিয়েছেন। ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণেও তা স্পষ্ট। কারণ, আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি, উড়িষ্যারাজ প্রথম নরসিংহদেব ১২৪৪ খৃস্টাব্দে রাজনগর দখল করেছিলেন। বক্রেশ্বরধাম ছিল রাজনগরের অধীনে। তাই বলা যায়, বক্রেশ্বরের প্রাচীন মন্দিরটি প্রাকৃতিক বা অন্য কোনো কারণে বিনষ্ট হয়ে গেলে উড়িষ্যারাজ প্রথম নরসিংহদেবই এখানকার বর্তমান শিব মন্দিরটি তৈরি করিয়ে দেন। এই মন্দিরের ভেতরে এবং বাইরে রয়েছে উড়িষ্যার স্থাপত্যশৈলীর প্রভাব। যেমন, বক্রেশ্বরের মূল শিব মন্দির ও তার সংলগ্ন সভাগৃহটি পুরীর হরচণ্ডী মন্দিরের আদলে তৈরি এবং এই সভাগৃহ থেকে দেবদর্শণের জন্য সোজাসুজি মেঝের করিডোরসহ দু’পাশের দু’সারি থামের উভয় পাশের রাস্তা আর মাথার ওপরের অর্ধবৃ্ত্তাকার ছাদ–এসব কিছুই উড়িষ্যার পুরী ও ভুবনেশ্বর মন্দিরের আদলে তৈরি। এছাড়াও বক্রেশ্বর শ্বেতগঙ্গার পাড়ে অক্ষয় বটতলায় পড়ে থাকা ভাঙা হরগৌরী মূর্তির মুখটাতেও উড়িষ্যা দেশীয় ভাস্কর্য রীতির ছাপ দেখা যায়। ইংরেজ আমলে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে সাঁওতাল বিদ্রোহের পর সাঁওতাল পরগনা গঠনের আগে পর্যন্ত অখণ্ড বীরভূমের অংশ ছিল বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যে অবস্থিত দেওঘরের বৈদ্যনাথ শিবের মন্দির। এটিও উড়িষ্যার স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত। এটিও উড়িষ্যারাজ প্রথম নরসিংহদেবের তৈরি। তাই বলা যায়, বীরভূমের প্রান্তিক অঞ্চল রাজনগরে কালীদহের মাঝে বিজয়স্তম্ভ থেকে শুরু করে এ জেলার দুবরাজপুর থানার বক্রেশ্বরের শিব মন্দির, অক্ষয় বটতলার পাথরের তৈরি হরগৌরী মূর্তি এবং বতর্মান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দেওঘরের বৈদ্যনাথ মন্দির– উড়িষ্যা দেশীয় স্থাপত্য-ভাস্কর্য শৈলীর প্রভাবেই নির্মিত। বীরভূম-ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন জায়গায় এখনো জেগে রয়েছে এক টুকরো করে উড়িষ্যা।
তথ্যসূত্র :
১) বাঙ্গালার ইতিহাস ( ১ম খণ্ড) : রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোমোহন প্রকাশনী, কলকাতা, বাংলা ১২ ই শ্রাবণ, ১৩৮৯.
২) বাঙালীর ইতিহাস ( আদি পর্ব ): নীহাররঞ্জন রায়, ৭ ম সংস্করণ, ফাল্গুন ১৪১৬, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা।
৩) বাংলায় মুসলিম অধিকারের আদিপর্ব : সুখময় মুখোপাধ্যায়, সাহিত্যলোক, কলকাতা, জুন,১৯৮৮.
৪) বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার ( বীরভূম) : এল, এস,এস ও’ ম্যালি, পুনর্মুদ্রণ,পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ১৯৯৬,
৫) বীরভূম জেলার পুরাকীর্তি : দেবকুমার চক্রবর্তী, পূর্ত বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার
৬) ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ প্রকাশিত বিভিন্ন জার্নাল এবং
৭) ব্যক্তিগত ক্ষেত্র সমীক্ষা।