প্রত্নতত্ত্বের আলোকে বীরভূমের প্রথম গ্রাম ও গ্রামবাসীরা

উত্তম মণ্ডলঃ

বীরভূমের প্রথম গ্রাম ও গ্রামবাসীদের খুঁজতে বর্তমান সময় থেকে প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার বছর পিছিয়ে চলুন। …দেখবেন, পৃথিবীতে তখন প্রাচীন প্রস্তর যুগ চলছে। আর সেই আদিম যুগেও যে আমাদের বীরভূমে লোকজন বসবাস করতো, প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে তার প্রমাণ মিলেছে। এই সময় বীরভূমে অ্যাকিওলিয়ান (acheolian) সংস্কৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজনের বসবাস ছিল বলে জানা গেছে। পৃথিবীতে এই সংস্কৃতির সূচনা ঘটেছিল প্রায় ১ লক্ষ ৫০ বছর আগে, আর ভারতবর্ষে ঘটেছিল ১ লক্ষ ২০ হাজার বছর আগে এবং বীরভূমে আরও কিছুটা সময় পরে। বীরভূমে এই সাংস্কৃতিক নিদর্শন পাওয়া গেছে মূলত জেলার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত চিলা নালার ধারে মলুটি সদর ঘাট থেকে। এই সংস্কৃতির লোকেরা হাত কুঠার, ক্লীভার, চপার, স্ক্র‍্যাপার ব‍্যবহার করতো বলে এখানকার তিনটি প্রত্নস্থল থেকে প্রমাণ মিলেছে। এছাড়াও এখান থেকে জীবাশ্মীভূত দাঁত বা হাড়ের যে নিদর্শন পাওয়া গেছে, তা হলো ষাঁড় ও হরিণের। তার মানে, সে সময় এ এলাকায় এই দুটি জীব ঘুরে বেড়াতো। এই সংস্কৃতির লোকেরা ব‍্যাসাল্ট, কোয়ার্টজাইট, চার্ট ও জাসপার জাতীয় পাথর থেকে তাদের হাতিয়ার তৈরি করেছিল। সিউড়ি থানার অন্তর্গত জীবধরপুর অঞ্চল থেকেও এই যুগের মানুষের তৈরি এরকম হাতিয়ার পাওয়া গেছে, যা এখানে ওই সংস্কৃতির লোকজনদের বসবাসকে প্রমাণ করে। এরপর পৃথিবীতে এসেছিল মধ্য পুরা প্রস্তর যুগ। এই যুগের সময়সীমা ছিল ১ লক্ষ ৫০ হাজার থেকে ১০ হাজার বছর আগে। সিউড়ি থেকে ১২ কিমি উত্তরে মহম্মদ বাজারের হাতগাছা মৌজায় এই যুগের নিদর্শন মিলেছে। এই সময় বীরভূমে শিকার-সংগ্রাহক গোষ্ঠীর আগমন ঘটেছিল। পরবর্তীকালে পৃথিবীতে শুরু হয় শেষ পুরা প্রস্তুর যুগ। আজ থেকে প্রায় ১ লক্ষ বছর আগে এই যুগেই মানুষ উন্নীত হলো “হোমো স‍্যাপিয়েন্স” বা বুদ্ধিমান মানুষে। ভারতে এই সংস্কৃতির সময়সীমা ছিল ২০ হাজার থেকে ১০ হাজার বছর আগে। এই সময়কার লোকেরা অনেক বেশি ব্লেডের ব‍্যবহার করেছিল। আজ থেকে প্রায় ১০ হাজার বছর আগে মধ্য প্রস্তর যুগের মানুষেরা পাথরের ছোট অথচ চকচকে ধারালো হাতিয়ার তৈরি করেছিল। এরপরই পৃথিবীতে শুরু হয়ে যায় নতুন পাথরের যুগ, যা তাম্র-প্রস্তর যুগ পেরিয়ে লৌহ যুগের সূচনাকাল পর্যন্ত ব‍্যাপ্ত ছিল। এই পর্বে আগের তুলনায় অনেক বেশি সহজ স্বচ্ছন্দে শিকার-সংগ্রাহক গোষ্ঠীর লোকজন বীরভূমের মাটিতে ঘোরাফেরা করতো এবং এ সময় তারা অজয় নদ, বক্রেশ্বর নদী ও কোপাই নদীর আশেপাশে ছড়িয়ে পড়েছিল আরও ভালো শিকারের খোঁজে। এ জেলার লাল মাটির উচুঁ জায়গাগুলিতে রেখে গেছে তারা তাদের পদচিহ্ন। বোলপুর-শান্তিনিকেতনের পারুল ডাঙা, সুখবাজার, তাতারপুর, কোণ্ডাইপুর, হেতমপুর, দুবরাজপুর, সিউড়ি, নলহাটি, বক্রেশ্বর প্রভৃতি জায়গায় শিকার-সংগ্রাহক গোষ্ঠীর লোকজনের ঘোরাফেরা ছিল বলে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে জানা গেছে। শান্তিনিকেতনের অনতিদূরে মহিষদল প্রত্নস্থলের উৎখনন এ জেলার গ্রামীণ সভ‍্যতার ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে আমাদের সামনে। এ থেকে আজ স্পষ্ট করেই বলা যায়, নতুন প্রস্তর যুগেই বীরভূমের লাল মাটির বুকে গড়ে উঠেছিল প্রথম গ্রাম। আর সে গ্রাম গড়ে উঠেছিল নদী বিধৌত পলি মাটির বুকে। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামের দূরত্ব ছিল প্রায় ৫ কিমি এবং ৪ থেকে ৬ একর জায়গা জুড়ে গড়ে উঠেছিল এক-একটি গ্রাম। নানুর, মহিষদল, হারাইপুর, বাহিরী, হাট-ইকড়া, কোটাসুর প্রভৃতি এলাকায় প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে বীরভূমে এই গ্রাম-সংস্কৃতির নিদর্শন মিলেছে। এই সময়কার এক-একটি গ্রামের এক-এক রকম জিনিস তৈরির সুনাম ছিল। যেমন, বীরভূমের টিকরবেথার কাসা-পিতলের বাসন, তাঁতিপাড়ার জিলিপি, সিউড়ির মোরব্বা, পছিয়াড়ার গামছা, ইলামবাজারের গালা শিল্প প্রসিদ্ধ ছিল একসময় এ জেলায়, তেমনি সেই প্রাচীনকালেও ছিল এই রকম বিশেষ জিনিস তৈরির ঘরানা। মহিষদলে প্রাপ্ত নিদর্শন থেকে জানা যায়, এই সময় মানুষের প্রধান জীবিকা ছিল কৃষি। মোষ, ভেড়া, শুয়োর, নীল গাই, সম্বর হরিণ, বন বিড়াল, নেকড়ে ও কুজবিশিষ্ট ষাঁড়ের পোড়া হাড়ের নিদর্শন মিলেছে। এসব জন্তুরা তখন এই এলাকায় ঘুরে বেড়াতো এবং মানুষেরা এগুলোকে শিকার করতো। আর মাছ, শামুক, কচ্ছপ খেতো তারা। তবে প্রধান খাদ্য তালিকায় মাছ ততটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। এরা বাস করতো মাটির বাড়িতে এবং বাড়িগুলো ছিল আয়তনে ছোট। সেখানে কমবেশি ১০ জন লোক নিয়ে থাকতো এক-একটি পরিবার। তারা আগুনের ব‍্যবহার জানতো। মৃতদেহকে তিনভাবে সমাধি দিতো তারা, প্রলম্বিত সমাধি (extended burial), অর্ধ সমাধি (fractional or secondary burial) এবং কুম্ভ সমাধি ( urn burial)। এরা লোহার ব‍্যবহার জানা গোষ্ঠীর লোকেদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল। রেডিও কার্বন পরীক্ষার ভিত্তিতে জানা যায়, এই সংস্কৃতি প্রায় ৭০০ বছরের বেশি স্থায়ী হয়েছিল। মহিষদল প্রত্নক্ষেত্রের উৎখনন কাজ পরিচালনা করেন এই লেখকের শিক্ষক বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথিতযশা অধ‍্যাপক নির্মলচন্দ্র ঘোষ ১৯৮৬ খৃষ্টাব্দে। এখান থেকে পাওয়া গেছে ভূ-স্তরের ১.২৫ মিটার গভীরতায় ১.১৮ মিটার জায়গা জুড়ে পোড়া চালের নিদর্শন। এ থেকে অধ‍্যাপক ঘোষ হিসেব করে দেখিয়েছেন, এখানে বছরে প্রায় ১৮০ কুইন্ট‍্যাল ধান উৎপন্ন হতো এবং এরজন্য প্রয়োজন ছিল ৭২ একর কৃষি জমির। অন‍্যদিকে, এখানকার জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৭০০ বর্গ মিটার এলাকায় প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ জন। এই হিসেব থেকে প্রতিটি গ্রামের গড় জনসংখ্যা ২০০ জন ধরা হলে গোটা পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা নতুন প্রস্তর যুগে ছিল ১০ হাজার। …আজকের দিনে ভাবলে অবাক হতে হয় বৈকি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *