‘মা’

সোমদত্তা চ্যাটার্জীঃ

এবার ডিসেম্বর মাস হল ‘মা’-এর মাস।‌ সারদা মায়ের জন্মদিন ৮ পৌষ ১২৬০ বঙ্গাব্দ। যেটা সেবছর ছিল ২২ ডিসেম্বর ১৮৫৩ খ্রীঃ। আর তিথি ছিল কৃষ্ণা সপ্তমী। এই তিথি সব বছর যে ডিসেম্বর মাসে পড়ে তা নয়। অনেক সময় জানুয়ারী মাসেও পড়ে। এবার এই তিথিও ডিসেম্বরেই। তাই এবার ডিসেম্বর একেবারেই ‘মা’-এর মাস। আমরা যারা ‘মা’-এর বাছা, তাদের নিত্যদিনই মাতৃময়। তবু এমাসে ‘মা’-এর কথা বলতে বড় সাধ যায়।


এখন একটা কথা খুব শোনা যায় – অ্যাপ্লায়েড। অর্থাৎ কোনো জ্ঞান কেবলমাত্র তত্ত্বগত থাকলেই চলবে না। তাকে আমাদের জীবনে কাজে লাগাতে হবে। আমাদের বিভিন্ন শাস্ত্র জ্ঞান কে জীবনে কিভাবে অ্যাপ্লাই করা যাবে – তা আমাদের হাতে-কলমে শেখাতেই যেন এবার এসেছিলেন মা, ঠাকুর। মা আর ঠাকুরের কথা তো আলাদা ভাবে বলা যায় না। একজনের কথা বললেই অপরের কথা আপসে আসে।


আমাদের সনাতন হিন্দু সমাজে বর্ণাশ্রম প্রথা বা জাতপাতের ভেদাভেদ এখনও আছে। সেই কবে মহাভারতের যুগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতা তে বলেছেন বর্ণ ভেদ তিনিই স্থাপন করেছেন। তবে এটি জন্মগত ভেদ নয়। আদতে এটি গুণগত ভেদ। মানুষ যে গুণ বা‌ চরিত্র গত বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মেছে, সেই বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তার বর্ণ নির্ধারিত হবে। আমরা গীতা কে মাথায় ঠেকিয়ে, লাল শালুতে মুড়ে তাকে তুলে রাখলাম। পড়লাম না, বুঝলাম না। শুধু মাত্র পেন্নাম ঠুকলাম। ফল যা হবার তাই হলো। গোটা সনাতন হিন্দু সমাজ জাতপাতের পঙ্কিল আবর্তে ডুবে যেতে লাগলো। তারপর এলো সেই মারাত্মক মধ্যযুগ। পৃথিবী ব্যাপী বিকট অন্ধকার। সময় সতত চলমান। মধ্যযুগও কেটে যাবার সময় হলো।
সেই যুগসন্ধিক্ষণের ঊষা কালে এলেন ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেব। সঙ্গে এলেন আমাদের মা, সারদামণি দেবী। ঠাকুর এবার অশক্ত শরীর, অল্প আয়ু নিয়ে এসেছিলেন। তিনি চলে গেলেন। রেখে গেলেন তাঁর শক্তি কে–আমাদের ‘মা’। ঠাকুর থাকতে মা ছিলেন অবগুণ্ঠনবতী। কিন্তু ঠাকুরের দেহ যেতে মা নিজের দশভুজা রূপ প্রকাশ করলেন।


না, আক্ষরিক অর্থেই মায়ের দশখানা হাত গজায়নি বটে, তবে এই সমাজের পঙ্কিলতা পরিস্কার কি আর কেবল দুই হাতে করা যায়!? ঠাকুরের ইচ্ছানুসারে মা যেন দশহাতে সমাজের ক্লেদ সাফ করতে লেগে পড়লেন।
আমাদের সমাজের সবচেয়ে বড় সমস্যা বর্ণভিত্তিক বিভাজন। এই ভাগ মা, ঠাকুর মোটেই মানতেন না। তাই তো আমরা দেখি রামকৃষ্ণ পার্ষদদের মধ্যে বিভিন্ন বর্ণের মানুষের সমাহার। ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ সব একাকার। কেবল মাত্র বর্ণ ভিত্তিক ভেদই নয়, বিত্তের ভেদ, বিদ্যার ভেদ সবকিছু ঘুচিয়ে, মুছিয়ে সমাজ কে সাফ করতেই এবার এসেছিলেন দিব্য দম্পতি।
এ কথা তো সবারই জানা – তৎকালীন কলকাতার বাবু রাম দত্ত ছিলেন ঠাকুরের ভক্ত-সেবক। আর তাঁর বাড়ির চাকর ছিলেন বিহারী বালক লাটু‌। মায়ের কাজের সুবিধের জন্য ঠাকুরের ইচ্ছেয় দক্ষিণেশ্বরে রয়ে গেলেন লাটু। লাটু কে কোলে টেনে নিলেন মা, ঠাকুর। বাবু রাম দত্ত যা ছিলেন, তাই-ই রইলেন। হতদরিদ্র, নিরক্ষর বালক লাটুর ঘটে গেল মহা উত্তরণ। বাড়ির চাকর থেকে তিনি হলেন শ্রী রামকৃষ্ণ পার্ষদ, স্বামী অদ্ভুতান্দ। সমাজের বিত্তের অহংকার, বিদ্যার অহংকার ভেঙ্গে চুরমার। ভবিষ্যত কালে স্বামী বিবেকানন্দ যে, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব ভারতবাসী কে ভাই বলে ডাকবেন – যেন তৈরী হলো তারই ভিত্তিভূমি।


ভারতে বিভিন্ন বর্ণের মানুষের যেমন বাস, ঠিক তেমনি বিভিন্ন ধর্মের মানুষের বাসও বটে। এই ভেদও সমাজের পক্ষে ভীষণ মারাত্মক। বর্ণভেদের মতো ধর্মভেদও যাতে সমাজের সুষ্ঠতা নষ্ট না করে, সেদিকেও ছিল তাঁদের প্রখর দৃষ্টি। জাতিভেদের মতোই মা ধর্মভেদও মানতেন না। তাই ইসলাম ধর্মাবলম্বী আমজাদ কেও সন্তান হিসেবে মান্যতা দিতেন। নিজ হাতে ভাত বেড়ে তাঁকে খাওয়াতেন তো বটেই, এমনকি তাঁর এঁটো পাত পরিষ্কার করতেও দ্বিধা বোধ করতেন না। মায়ের খুকী, ভগিনী নিবেদিতা এবং পাশ্চাত্যের তাবৎ ভক্তকূল তো ছিলেন জন্মসূত্রে খ্রীষ্টান। তাতে কী? ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের আপন করে নিতে মায়ের জুড়ি মেলা ভার। জন্মসূত্রে যার যা ধর্মই হোক না কেন, এখানে সবাই মায়ের সন্তান। হিন্দু-মুসলিম-খ্রীষ্টান মিলেমিশেই তো মায়ের পরিবার। পরিবারের সব সদস্য মিলেমিশে থাকলে, তবেই তো পরিবার সমৃদ্ধ হয়। সমাজের ক্ষেত্রেও ঠিক এই কথাটাই খাটে। আজকের এই ভেদবুদ্ধির বাড়বাড়ন্তে তাই, মা আমাদের সদা প্রাসঙ্গিক।
জয় ‘মা’ জয় ‘মা’ জয় জয় ‘মা’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *