সোমেশ্বর বড়ালঃ
আবির্ভূত হয়েছিলেন ১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারী, এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান ১৯০২ সালে, ৪ জুলাই–মাত্র ৩৯ বছর ৫ মাস ২৪ দিনের বয়সে। শিকাগো ধর্মসভায় অংশগ্রহন করেন ১৮৯৩ সালে অর্থাৎ বয়স তখন তিরিশ। মাত্র ৩৯ বছর যিনি নরদেহে ছিলেন ১৬০ বছর পরও কেন তাঁকে আমরা স্মরণ করছি? ১৩০ বছর আগে যিনি একটা ভাষণ দিয়েছিলেন তা নিয়ে কেন আমরা এখনও ভাবি? এই দুটি প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই আছে স্বামিজী কি বলেছিলেন, কি করেছিলেন। স্বামীজী নতুন কিছুই বলেননি, তিনি ৩৯ বছরের জীবনে বিবেকানন্দইজম বা বিবেকবাদ বলে নতুন কিছু তৈরী করেননি – এবং শিকাগোর ধর্মসভাতেও যা বলেছিলেন তাও নতুন কিছু নয়। শাশ্বত ভারতের সনাতন সংস্কৃতিটি তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, হাজার হাজার বছর আগে তপোবনের ঋষিরা যে ভাবনা মন্থন করে গেছিলেন তাই তিনি নতুন ভাবে ব্যখ্যা করেছিলেন মাত্র, সহজভাবে মানুষের সামনে তুলে ধরেছিলেন। তিরিশ বছরের নবীন সন্ন্যাসীর কণ্ঠ থেকে বিশ্ব যা শুনেছিল তা আসলে হাজার হাজার বছরের সাধনায় লব্ধ জ্ঞান বা অনুভব। এজন্যই তা পাশ্চাত্য কে চমকে দিয়েছিলো, এজন্যই আজ স্বামিজী সমানভাবে প্রেরণার উৎস। স্বামী বিবেকানন্দ হিন্দু ধর্মকে তথাকথিত সংস্কার করেননি বা নতুন কোন সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করেননি। ভগিনী নিবেদিতার ভাষায়–‘যে রত্নরাজী ভারত নিজেরই মধ্যে ধারণ করিয়া রহিয়াছে, কেবলমাত্র সেগুলির প্রকাশকরুপে, ব্যখ্যাতারুপে স্বামিজী বিরাজমান’।
১৮৯২ এর এপ্রিল মে মাস থেকেই ধর্ম মহাসম্মেলনে যোগদানের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হচ্ছিলেন। প্রস্তুতি গতি পায় ১৮৯৩ এর জানুয়ারী থেকে। তখনও তিনি স্বামী সচ্চিদানন্দ। মাদ্রাজ, হায়দ্রাবাদে বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি তার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সেখানকার শিক্ষিত যুবকেরা, ব্যবসায়ীরা, অনুগামীরা অর্থ সাহায্য দিতে এগিয়ে আসেন। ১৮৯৩ সালের ২১ এপ্রিল ক্ষেত্রীর মহারাজার এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন, শোনা যায় ক্ষেত্রীর মহারাজার অনুরোধেই সচ্চিদানন্দ থেকে বিবেকানন্দ নাম গ্রহণ করেন। ৩১ মে ‘পেনিনসুলার’ জাহাজে বোম্বাই থেকে বিদেশ যাত্রা করলেন।
এতবড় ধর্মসভা তখনো অব্দি পৃথিবীতে প্রথম। ধর্মসভার প্রধান ব্যবস্থাপক হেনরি ব্যারজের কথায় তারা প্রায় তিরিশ মাস ধরে এর প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। খাতায় কলমে ধর্ম সভার উদ্দেশ্য ছিল খুব মহৎ – কিন্তু বাস্তবে তা ছিল সব ধর্মের উপস্থিতিতে খ্রিস্ট ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করা। ওই ধর্মসভার আয়োজক সমিতির সভাপতি চার্লস বনি কে উদ্ধৃত করে ১৮৯৪ সালের ১১ অক্টোবর ‘দি বাল্টিমর পোস্ট‘ নামের পত্রিকায় লেখা হয়– , ‘প্রেসিডেন্ট বনি বলেন যে বিশ্ব ধর্মমহাসভা আসলে খ্রিস্টান ধর্মকে সর্বোত্তম হিসাবে চিহ্ণিত করার জন্য আয়োজিত হয়‘। ১১ সেপ্টেম্বর তার বক্তৃতা ইতিহাস সৃষ্টি করলো, ২৭ সেপ্টেম্বর অব্দি প্রায় প্রতিদিনই তাকে বলতে হয়। আমেরিকায় বিভিন্ন বড় বড় জায়গায়, এরপর ইউরোপ। প্যারিস, লন্ডন থেকে আবার আমেরিকা। ১৮৯৬ এ আবার লন্ডন। সেখান থেকেই ১৮৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারী কলোম্বো এসে পৌঁছান।
‘আমি সেনাপতি নই, রাজা নই, ধনী নই, কিছু নই – আমি শুধু সন্ন্যাসী। তা সত্ত্বেও সমাজের উচ্চপদস্থ ও সম্মানিত ব্যক্তিরা আমাকে সম্মান জানাতে এসেছেন। এক ভিখারি সন্ন্যাসীকে এই যে রাজোচিত সম্মান প্রদর্শন – হিন্দুদের আধ্যাত্মিক ভাবই তাতে প্রকাশিত হয়েছে। আমার প্রতি এই যে সম্বর্ধনা – এ আমার জন্য নয়, আমি যে আদর্শের জন্য দাঁড়িয়ে আছি তার জন্য’। – ১৫ জানুয়ারী কলোম্বোয় সংবর্ধনার উত্তরে এই কথাগুলি স্বামিজী বলেছিলেন।
স্বামীজী শিকাগো ভাষণের পর প্রায় তিন বছর পাশ্চাত্যে রইলেন। একের পর এক বড় বড় শহরে বক্তৃতা দিলেন, সেখানকার শিক্ষিত মানুষের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিলেন। তার প্রত্যক্ষ ফল হল – ভারতবর্ষ ও হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে আমেরিকা বা ইউরোপে যে নেতিবাচক ধারণা ছিল তা বদলাতে শুরু করলো। তারা ভাবতে লাগলো – মিশনারীরা সঠিক কথা বলে না – যে সভ্যতা স্বামী বিবেকানন্দের মত এমন একজন বিরাট ও মহৎ মানুষের জন্ম দেয় সেই সভ্যতা নিঃসন্দেহে এই মহান ও উজ্জ্বল সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। আমেরিকার মানুষ তার নাম দিলেন ‘সাইক্লনিক মঙ্ক’। স্বামীজী তার বক্তৃতায় বলেছিলেন–, ‘যে ধর্ম জগতকে পরধর্মের প্রতি ঔদার্য ও সর্ববিধ ধর্মমতকে স্বীকৃতি দান করিতে শিখাইয়াছে, আমি সেই ধর্মভুক্ত বলিয়া নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি। আমরা যে শুধু অন্য ধর্মাবলম্বীকে সমদৃষ্টিতে দেখি তাহা নহে, সকল ধর্মকেই আমরা সত্য বলিয়া বিশ্বাস করি। …এই ধর্মসভা গীতা প্রচারিত অপুরব সত্যেরই পোষকতা করিতেছে – যে কোন লোক যে কোন পথ ধরিয়াই আমার কাছে আসুক না কেন, আমি তাহাকে সেইভাবেই গ্রহণ করিয়া থাকি। সব মানুষের চলার পথই পরিণামে আমাতে আসিয়া পৌঁছায়’ – একথা স্বামীজীর নিজের কথা নয় গীতার বানী – ‘যে যথা মাম প্রপদ্যান্তে তাংস্তথৈব ভজামাহম / মম বরত্মানু বরতন্তে মনুস্যা পার্থ সর্বশ’ এই ভাষণের পর অজ্ঞাত অখ্যাত এক তরুন সন্নাসী বিশ্বখ্যাত হয়ে গেলেন। আমেরিকায় স্বামিজীর সফর এবং বেদান্তের প্রচারের ফলে ভারতের প্রতি জগতের শ্রদ্ধা ফিরে এলো। অবশিষ্ট বিশ্ব বুঝল রাজনৈতিকভাবে পরাধীন অর্থ, প্রযুক্তি, তথাকথিত আধুনিকতায় পিছিয়ে থাকা ভারতবর্ষ এমন সম্পদে ধনী যা অন্যদের নেই। নিউইয়র্কে স্বামিজী ‘বেদান্ত সোসাইটি’ স্থাপন করে ফেললেন। ভাবুন প্রায় রবাহুত, নিঃসহায়, গুরুদেবের আশীর্বাদ সম্বল করে তিরিশ বছরের যে যুবক সন্নাসী আমেরিকা যাত্রা করেছিলেন একটি বক্তৃতা পাশ্চাত্যের জ্ঞান ও বুদ্ধির জগতে তার পাসপোর্ট হয়ে গেছিলো। যদি না তিনি রবাহুত হয়ে ধর্ম মহাসম্মেলনে না যেতেন, যদি না এগারোই সেপ্টেম্বর ওই মঞ্চে ওঠার সুযোগ না পেতেন তবে পাশ্চাত্য তাকে চিনতো কিনা তা সন্দেহের।
ভারতবর্ষে সন্ন্যাসীরা শুধু মানুষের পরকালের জন্য ভাবেননি, ভাবাননি। বুদ্ধ, শঙ্কর, চৈতন্য, গুরু নানক থেকে শুরু করে স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী প্রনবানন্দ এরা সবাই সমাজকে সংগঠিত, সমর্থ ও সংস্কারিত করার উদ্যোগ নিয়েছেন। শুধু মঠ নয় স্বামীজী মিশন গঠন করেছেন। শুধু আশ্রমের মধ্যে ভজন পুজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে রাষ্ট্র পরিচালন ব্যবস্থা সম্পর্কে ন্ন্যাসীরা ভেবেছেন। স্বামী বিবেকানন্দের কথা ‘এডিট’ করে ব্যবহার করে বিভ্রান্তি ছড়ানো কিছু মানুষের স্বভাব। গীতাপাঠ ও ফুটবল সম্পর্কিত স্বামীজীর সম্পূর্ণ বাণীটি হল – ‘ হে আমার যুবক বন্ধুরা, তোমরা সবল হও – তোমাদের কাছে এই আমার বক্তব্য। গীতাপাঠের চেয়ে ফুটবল খেললে তোমরা স্বর্গের আরও নিকটবর্তী হবে। আমাকে অতি সাহসের সঙ্গে এ কথাগুলো বলতে হচ্ছে, কিন্তু না বললেই নয়। আমি তোমাদের ভালবাসি। আমি জানি, সমস্যাটা কোথায়। …আমার কিছু অভিজ্ঞতা আছে। তোমাদের বলি, তোমাদের শরীর একটু শক্ত হলে তোমরা গীতা আরও ভাল বুঝবে’। – এই পুরোটা পড়ে কি মনে হয়– স্বামীজী গীতা পড়তে বারণ করেছেন? স্বামীজী বলেছেন– ‘ আমাদের কাজের মূল কথাটা সবসময় মনে রাখবে – ‘ধর্মে একবিন্দু আঘাত না করে জনসাধারণের উন্নতিবিধান’।
আমরা যারা চাইছি স্বামীজীর ভাবনায় ভারত গড়তে তাদের কাছে স্বামীজীর ভারত ভাবনাটি স্বচ্ছ হওয়া দরকার। এই দেশ মহান দেশ। পৃথিবীর মানব সভ্যতায় এই দেশের অপরিসীম অবদান আছে। প্রাচীন ভারত আধ্যাত্মিকতা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, অর্থনীতি সর্বক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ ছিল। আমাদের অধপতনের মুল কারণ গুলি হল – গৌরবময় অতীত কে ভুলে যাওয়া, ঐতিহ্য কে অবহেলা করা আর সর্বোপরি এক শ্রেণীর ধনী, তথাকথিত উচ্চবর্ণের মানুষ একটা বড় অংশের মানুষকে ক্রমাগত অবহেলা ও অপমান করে দেশের মুল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করা। ধর্মে যখন গ্লানি আসে তখন অবতার আবির্ভূত হয়ে থাকেন, তিনি আসেন সংস্কারকের ভুমিকায়। সংস্কার করা মানে কখনই মুল কাঠামোটিকে ধ্বংস করা নয়; সময়ের সঙ্গে যে ক্লেদ জমে তা অপসারণ করে সময়োপযোগী ভাবনার সমন্বয় করেন সংস্কারকগণ। এই ভুমিকাই পালন করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ।
আত্মবিস্মৃত ভারতবাসীকে নতুনভাবে ভাবতে শিখিয়েছিলেন – সনাতন ভারতীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে গৌরববোধ করতে প্রাণিত করেছিলেন। ঘুমন্ত সিংহ জাগ্রত হতে থাকে, তারুণ্যের জোয়ার আসে, নতুন কিছু করার উদ্যম শুরু হয়। তিনি বলেছিলেন – ‘ভারত আবার জাগিবে, জড়ের শক্তিতে নয়, চৈতন্যের শক্তিতে’। স্বামীজীর স্বপ্নের ভারত আজ বাস্তবায়িত হওয়ার পথে – সেই দিন আর দূরে নেই – ভারত যেদিন বিশ্ব গুরুর আসনে অধিষ্ঠিত হবে।