নয়াপ্রজন্ম প্রতিবেদনঃ
১৩ জানুয়ারি শনিবার সাহিত্য অকাদেমির উদ্যোগে সাহিত্য অকাদেমির পূর্বাঞ্চল কার্যালয়ের কলকাতা অফিসের প্রেক্ষাগৃহে যুব পুরস্কার ২০২৩ প্রাপকদের নিয়ে একটি সম্মেলনের আয়োজন করে। সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন সাহিত্য অকাদেমির উপ-সভাপতি অধ্যাপিকা কুমুদ শর্মা। সভাপতির ভাষণে তিনি এইসকল তরুণ লেখকদের সৃজনাত্মক লেখার ভূয়সী প্রশংসা করার পাশাপাশি, তাঁদের লেখায় ফুটে ওঠা মানবিকতার কথাও বলেন। তবে তিনি এও বলেন যে লেখার সময়ে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখার গুরুত্ব সর্বাধিক। অনুষ্ঠানে পুরস্কার প্রাপকেরা নিজেদের সৃজনাত্মক অভিজ্ঞতা শ্রোতাদের সঙ্গে ভাগ করে নেন।
নিজের জীবনের প্রাথমিক সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে জিন্তু ঠাকুরিয়া (অসমীয়া)জানান যে দেশ, কাল ও সত্ত্বার পারস্পরিক নিবিড়তাই তাঁর গল্পের মুখ্য বিষয়বস্তু। সংখ্যায় নগণ্য হলেও তাৎপর্যপূর্ণ প্রান্তিক চরিত্রগুলি বরাবরই তাকে মুগ্ধ করেছে। যৌন নিপীড়ন, লিঙ্গ বৈসাদৃশ্য, নৈতিকতার বাধ্যতামূলক আরোপণ, মূল্যবোধের টানাপোড়েন, বিচ্ছিন্নতাবাদের অন্তঃসারশূন্যতা, সাংস্কৃতিক শৈথিল্যকে তিনি তাঁর গল্পে তুলে ধরতে চেয়েছেন। হামিরুদ্দিন মিদ্যার (বাংলা) জন্ম ও বেড়ে ওঠা গ্রামবাংলার কোলে। কাজেই, একদম গোড়া থেকেই গ্রামীণ কথকতা এবং মা-ঠাকুমার থেকে শোনা গল্পের ঝাঁপি তাঁকে সাহিত্যের পথ দেখিয়েছিল। মানুষ আর প্রকৃতির মেলবন্ধনে, মাঠে-ঘাটে কাজ করতে করতে কী না শিখেছেন তিনি — লোককথা, ছড়া, গ্রামীণ হেঁয়ালি আরও কত কিছু। এই সব কিছু মিলেই তিনি আজকের মানুষ। নিজের জীবনের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে, মৈনাওশ্রী দাইমারি (বোড়ো) বলেন যে তাঁর জীবনের যত অনুভূতি, দুঃখ-যন্ত্রণা তা সব প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম হিসেবেই তিনি কবিতাকে বেছে নিয়েছেন। পিতৃতান্ত্রিক এই সমাজে বাবা হারিয়ে একলা মায়ের কাছে মানুষ হয়েছেন তিনি। মেয়ে হওয়ার ফলে লিঙ্গবৈষম্য যে কী রূপ ধারণ করতে পারে তা তিনি চাক্ষুস করেছেন। তাঁর মতে সমাজ মুখে লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণের কথা বললেও কার্যক্ষেত্রে তা করতে চায় না। ভারতবর্ষের সংস্কৃতিগত এবং ভাষাগত বৈচিত্রের কথা বলার পাশাপাশি রাজনীতি নির্মাণে ইতিহাসের ভুমিকার কথা বলেন অনিরুদ্ধ কানিসেট্টি (ইংরেজী)। পুরাতন প্রজন্মের সঙ্গে বর্তমান প্রজন্মের পার্থক্য টেনে বর্তমান পরিস্থিতির কথা তুলে ধরেন তিনি। অতুল কুমার রাই (হিন্দী) তাঁর ভাষণে তাঁর শুরুর দিকের লেখাগুলির কথা বলেন এবং একইসঙ্গে সাহিত্যের সামাজিক দিককে মাথায় রেখে কীভাবে নিজের উপন্যাসকে তিনি সাজান তাও বলেন। মঞ্জুনায়ক চেল্লুরুর (কন্নড়) ভাষণে তাঁর জীবনসংগ্রামের কথা উঠে আসে। ছিন্নমূল মানুষের একাকীত্বের সুর শোনা যায় তাঁর লেখায়। স্মৃতিপটে ধরে রাখা বাল্যকালের কথা ধরা পড়েছে তাঁর লেখা গল্পগুলিতে। নিগহত নাসরীনের (কাশ্মীর) বক্তব্যে পারিবারিক সমস্যা, নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনাবলী, সামাজিক পরিবর্তন ও পণপ্রথা এবং গার্হস্থ্যহিংসার মতো সামাজিক অভিশাপের বিষয়গুলি কীভাবে তাঁর লেখালিখিতে উঠে এসেছে সেকথা ধরা পড়ে। কোঙ্কনী ভাষাভাষী অঞ্চলের ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং লোককথার সম্ভারের কথা উঠে আসে তনভী শ্রীধর কামাত বামবোলকারের (কোঙ্কনী) বক্তব্যে। বিশিষ্ট কোঙ্কনী লেখকদের কথা প্রসঙ্গে তিনি জানিয়ে দেন তাঁর লেখকসত্ত্বার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন তাঁরাই। কবিতার প্রকৃতি নিয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে সংস্কৃতি মিশ্র (মৈথিলী) বলেন যে কবি হিসেবে শুধুমাত্র সমস্যার কথা তুলে না ধরে সেই সমস্যার সমাধানের পথও তিনি দেখাতে চেয়েছেন। গনেশ পুথুর (মলয়ালম) তাঁর ভাষণে তাঁর ফেলে আসা জীবনের কথা বলেন এবং এও বলেন যে তাঁর কাছে সাহিত্যের মুখ্য বিষয়বস্তু বাস্তবতা। নিজের লেখালিখির উৎস প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে, মণিপুরের বর্তমান পরিস্থিতি যে কীভাবে মানুষের ওপরে ক্ষতিকারক প্রভাব বিস্তার করছে সেই কথা বলেন থিংগমবম পরশুরাম (মণিপুরী)।বিশাখা বিশ্বনাথ (মরাঠী) তাঁর ভাষণে সৃজনাত্মক সাহিত্যের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি নিয়ে বলেন। তাঁর কাছে সাহিত্য শুধুমাত্র কোন শৈলী নয় — এ এক যাত্রা — যে যাত্রাপথে বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলের মধ্যেই জন্ম নেয় নতুন সজীবতা। সাহিত্যের মধ্য দিয়ে নিজেদেরকে বারংবার প্রশ্নের মুখে ফেলে যাচাই করে নিই নিজেদের। নয়ন কলা দেবীর (নেপালী) মতে সাধারণ মানুষের জীবনকে ঘিরে সাহিত্যের পথ চলা উচিত। জনসমাজের আনন্দ ও দুঃখের পাশাপাশি তাঁদের নিত্যনৈমিত্তিক সমস্যা নিয়ে সাহিত্য রচনার প্রয়োজন আছে। দিলেশ্বর রাণা (ওডিয়া) তাঁর ভাষণে তাঁর লেখার উপরে কী কী বিষয়ের প্রভাব পড়েছে তা নিয়ে বক্তব্য রাখেন। কালাহান্ডির পরিবেশ, খাদানের পাশাপাশি বাসযোগ্যতার সংকট ঘনিয়ে আসা, মানবিকতার সংকট এ সবই ফুটে উঠেছে তাঁর লেখায়। এটাই কথকতার মূল ঐতিহ্য। তাঁর মতে যে সমস্যার সমাধান অসম্ভব তার থেকেই জন্ম নেয় গল্প। সন্দীপ শর্মা (পঞ্জাবী) তাঁর ভাষণে ভাষার প্রকৃতি এবং তাঁর বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁর মতে উত্তম সাহিত্যের কাছে ভাষা কোনও বাধা নয়। সে অচিরেই তার পথ করে নেয়। দেবী লাল মাহিয়া (রাজস্থানী) তাঁর বক্তব্যে রাজস্থানী ইতিহাস এবং সংস্কৃতির ঐতিহ্যের কথা তুলে ধরেন। রাজস্থানী সাহিত্য কীভাবে তাঁর লেখকসত্ত্বাকে গড়ে তুলেছে তাই ফুটে ওঠে তাঁর ভাষণে। মধুসূদন মিশ্র (সংস্কৃত) তাঁর বক্তব্যে সংস্কৃত সাহিত্যের ঐতিহ্যের কথা বলেন এবং সেই প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ লেখাগুলির কথা তুলে ধরেন। তিনি এই প্রসঙ্গে লিখনশৈলীর কথাও তোলেন। বাপি টুডু (সাঁওতালী) জানান যে তিনি বরাবরই চেষ্টা করে এসেছেন কীভাবে সাহিত্যের মাধ্যমে সাঁওতালী সমাজের সমস্যাগুলিকে আধুনিক প্রেক্ষিতে দেখানো যায়। সিন্ধি সাহিত্যের দিকপালদের কথা বলার পাশাপাশি তাঁরা কীভাবে তাঁর সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছেন সেই কথাই শোনা যায় মনিকা পাঞ্জোয়ানির (সিন্ধী) মুখে। রাম থংগম (তামিল) তাঁর ভাষণে ধ্রুপদী তামিল সাহিত্যের কথা বলেন। তিনি জানান যে লেখার সময়ে গল্পের বিষয়বস্তু হিসেবে বাস্তবকেই তিনি বেছে নিয়েছেন। তাক্কেদশিলা জনি (তেলুগু) তাঁর ভাষণে নিজের জীবনসংগ্রামের কথা বলার পাশাপাশি সামাজিক বিষয়গুলি কীভাবে তাঁর সাহিত্যে ঢুকে পড়েছে সেই কথাও বলেন। তৌসিফ খান (উর্দু) তাঁর ভাষণে জানান যে উর্দু ভাষাভাষীদের জগৎ বর্তমানে অনেকটাই পাল্টে গেছে। একইসাথে পাল্টেছে উর্দু সাহিত্যও। ধীরাজ কুমার রায়না (ডোগরী) অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেন নি। অনুষ্ঠানের শেষে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন সাহিত্য অকাদেমির আঞ্চলিক সচিব ড. দেবেন্দ্র কুমার দেবেশ।