সনাতন সৌঃ
সাধারণতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে পদ্মশ্রী সম্মান ঘোষণা করলো ভারত সরকার। এবারের পদ্মশ্রী প্রাপকদের তালিকায় রয়েছেন বাংলার গর্ব বীরভূমের প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব প্রখ্যাত লোকসঙ্গীত শিল্পী রতন কাহার এর নাম। তিনি ভাদু গানের জন্যই পদ্মশ্রী সম্মান পাচ্ছেন বলে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়। এখবরে জেলাবাসী খুবই গর্বিত। বিশেষ করে যে গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেই গ্রামের মানুষ তাঁকে নিয়ে উন্মাদনা করছেন। সিউড়ী থানার কেন্দুলী গ্রামের মানুষ ভূমিপুত্র রতন কাহারকে উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়েছেন। খুব শীঘ্রই গ্রামবাসী তাঁকে সংবর্ধনা ও সম্মাননা জানাবেন বলে গ্রামের পক্ষে ব্রজেশ তনয় দা৺ জানিয়েছেন। রতন কাহার এখন বৃদ্ধ হয়েছেন। তাঁর বয়স এখন ৮৮ বছর। একের পর এক লোকসঙ্গীতর ধারাকে সমদ্ধ করে গিয়েছেন তিনি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অনেক ছোট বড় পুরস্কার পেয়েছেন। পূর্বাঞ্চল তথা সংস্কৃতি কেন্দ্র,জেলা তথ্য সংস্কৃতি বিভাগ সহ বিভিন্ন গণ সংগঠন থেকে বহু পুরস্কার রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। তিনি জন্মেছিলেন বীরভূম জেলার অন্তর্গত সিউড়ী থানার অধীন কেন্দুলী গ্রামে। তাঁর পিতার নাম অচলচন্দ্র কাহার ও মায়ের নাম টুকটুকি কাহার। খুব অভাবের মধ্যে দিয়ে তাদের সংসার চলতো। ঠাকুরদা রাখহরি কাহার অন্ধ শিল্পী ছিলেন। গ্রামের পর গ্রামে গান গেয়ে মাধুকরী করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। বাবা মুনিশ খাটতেন।মা পরের বাড়ীতে কামিনের কাজ করতেন।এত অভাব ছিল যে, তাঁদের সংসার চলতো না। সে সময় ইংরেজ আমল, মহাজনদের ও ইংরেজ সাহেবদের চরম অত্যাচার চলতো। এই মহাজনদের অত্যাচারে ও অভাবের তাড়নায় কেন্দুলী গ্রাম ছেড়ে চলে গেলেন মামার বাড়ি সিউড়ী ত্রান সমিতির কাছে নগরী পাড়ায়। খুব অভাবের মধ্যেও তিনি গান বাজনা চালিয়ে যাচ্ছেন।অভাবের জন্যই তিনি বিড়ি বাঁধতেন আর গান লিখতেন নিজের ভাষায়। এই গানের জন্যই তিনি বিভিন্ন জায়গায় ডাক পেতেন। মেয়ে সেজে নাটক, আলকাপ ও জলসায় অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছেন। বিশেষ করে ভাদু, ঝুমুর ও লোকো গানে নিজে সুর দিতেন।আপন ধারায় গান পরিবেশন করতেন। তাঁর লেখা বিখ্যাত গান- “বড় লোকের বিটি লো লম্বা লম্বা চুল, এমন মাথা বেঁধে দিবো লাল গান্দা ফুল।” এই গানটি তিনি ১৯৭২ সালে রচনা করেন এবং ১৯৭৭ সালে আকাশবাণী কলকাতায় গানটি পরিবেশন করেন। পরে ১৯৭৯ সালে গানটি রেকর্ড করেন স্বপ্না চক্রবর্তী। গানটি জনপ্রিয়তা শীর্ষ ছুঁয়ে এখনও আসমুদ্র হিমাচল মানুষের মুখে মুখে ফেরে। তিনি ভাদু ও ঝুমুর গানে অদ্বিতীয়, অতুলনীয়। বাউল সম্রাট পূর্ণ দাসের সঙ্গে গান গেয়ে বেড়িয়েছেন। জীবিকা নির্বাহের তাগিদে মহামায়া, অপেরা, শক্তি অপেরা প্রভৃতি যাত্রা দলে গান গেয়েছেন। নাটকও করেছেন। এক সময় সিউড়ী আনন নাট্যগোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। ওই সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আনন নাট্যগোষ্ঠীর শিল্পীদের সমবেতভাবে তার লেখা অংশ নিতেন। একক অনুষ্ঠান করতেন। তিনি রাজ্যের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান পরিবেশনের জন্য আমন্ত্রণ পান। ছোট বয়স থেকেই তিনি নিজেই গান লিখতে ও সুর দিতে শুরু করেন। আকাশবাণী কলকাতার আর্য চৌধুরীর একান্ত সহযোগিতায় ১৯৭৬ সালে বেতারে গান গাইবার সুযোগ পান।আম তানা না না, ভালো লাগে না, গানটি তাঁর কণ্ঠে প্রথম প্রচারিত হয়। আর্থিক সংকটের জন্য বেশি দূর লেখাপড়া করতে পারেন নি। তবুও সে নিজস্ব ভাবধারায় গান রচনা করেন এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগদান করে গান পরিবেশন করেন। তপশিলী সম্প্রদায়ভুক্ত এই শিল্পী নিদারুণ দুঃখ কষ্টের দিনযাপন করেও সহজ সরল সাবলীল নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে হারাতে নারাজ। দারিদ্র অবহেলা বঞ্চনার মাঝে দীর্ঘ সংগ্রাম করে লোকসঙ্গীত ও ভাদু গানকে বাঁচাতে বদ্ধপরিকর। রতন কাহার জানালেন, এই সম্মান আমি সাদরে গ্রহণ করছি। এ সম্মান আমার একার নয়, পিতা মাতার, ঠাকুরদা ও আত্মীয়- স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও অনুরাগীদের। তাদের আন্তরিকতায় আমি অভিভূত। তিনি জানালেন, বীরভূমের সুরেলা মাটিতে অজস্র সুর লুকিয়ে আছে। সেই সুর সাধনা করে অনুভূতি দিয়ে উপলব্ধি করে পাওয়া যায়।ভবিষ্যত প্রজন্ম যাতে এই গ্রামীণ সাংস্কৃতিক ও লোকসঙ্গীত ধারার ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে পারে তার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবো। তিনি গান গাইলেন —-
বীরভূমের রাঙামাটিতে,
গাইবো বাউল একতারা হাতে।
মনের আনন্দতে, দিন প্রভাতে,
আমাদের ভাঙায় কত সুখের ঘুম।
বিবাগী বাউলের দেশ ভাই,
মোদের বীরভূম —–।