
বিজয়কুমার দাসঃ
লোকসভা ভোটে সমস্ত বৈদ্যুতিন মাধ্যমের পূর্বাভাসকে নস্যাৎ করে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আস্থা রাখল মমতা ব্যানার্জীর তৃণমূল দলের প্রতিই। আসলে এবারের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে মোদি ঝড় তোলার চেষ্টা করা হয়েছিল। সেজন্য কেন্দ্রীয় সরকার চেষ্টার ত্রুটি করেনি।প্রস্তুতিটা শুরু হয়েছিল ভোট ঘোষণার আগেই। শুভেন্দু অধিকারী তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি তে যোগ দেওয়ার পরেই মোদি- মমতা সম্মুখ সমর জমে উঠেছিল। শুভেন্দু অধিকারীই হয়ে উঠেছিল নরেন্দ্র মোদি আর অমিত শাহর তুরুপের তাস। তাঁদের বিশ্বাস ছিল, যে শুভেন্দু বিধানসভায় নন্দীগ্রামে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীকে হারিয়েছিল, সেই শুভেন্দুকে দিয়েই এই বঙ্গে ধস নামানো যাবে তৃণমূলের গড়ে। শুভেন্দু অধিকারী হয়ে উঠলেন বিরোধী দলনেতা। তিনি একটার পর একটা দুর্নীতির অভিযোগে তৃণমূল সরকারকে কোণঠাসা করতে চেষ্টার ত্রুটি করেননি। বলার অপেক্ষা রাখে না, লড়াইটা জমে উঠেছিল। একদিকে দুর্নীতি, অন্যদিকে সন্দেশখালি নিয়ে যে ঝড় উঠেছিল, বিজেপির বিশ্বাস ছিল এই ঝড়ে লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল বিপর্যস্ত হবে। হাইকোর্ট আর সুপ্রিম কোর্ট এই পর্বে লড়াই এর ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল ন্যায়-অন্যায়ের দ্বন্দ্বে। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের মত মানুষ আইনের ময়দান ছেড়ে রাজনীতির ময়দানে খেলতে এসেছিলেন। ইতিমধ্যে তৃণমূলের বেশ কয়েকজন নেতা,মন্ত্রী জেলেও গেছেন। বিজেপির হয়তো ধারণা ছিল, এইসব ইস্যুতে লোকসভার ভোট জিতে নেওয়া যাবে। কিন্তু বঙ্গের মানুষ মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর নানা জনমুখী প্রকল্পের ওপরে আস্থা রেখে তাঁর পাশেই থাকার সবুজ সঙ্কেত দিয়েছে। ঝড় উঠেছিল সন্দেশখালি নিয়েও। প্রচারে অপপ্রচারে জমে উঠেছিল সন্দেশখালি। নির্যাতিতাদের মুখ হয়ে রেখা পাত্র প্রার্থী হয়েছিলেন বিজেপির। কিন্তু যে মোদি ঝড়ের কথা বিজেপি বারবার বলেছে সেই ঝড় মুখ থুবড়ে পড়ল সন্দেশখালিতেই। এটা যেমন মমতা ব্যানার্জীর জয়, তেমনি শুভেন্দু অধিকারী বা বিজেপির বড় পরাজয়।
এই যুদ্ধে মমতা একাই লড়লেন প্রথম থেকে মোদি ঝড় সামাল দিতে। যোগ্য সঙ্গত করলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতার প্রার্থী তালিকায় অন্য রাজ্যের অধিবাসী অভিনেতা শত্রুঘ্ন সিনহা, ক্রিকেটার কীর্তি আজাদ, ইউসুফ পাঠানরাও ছিলেন। তাঁরা জিতেও গেলেন। অধীর চৌধুরী, দিলীপ ঘোষ, সুরেন্দ্র সিং আলুওয়ালিয়ার মত জোরদার প্রার্থীরাও হেরে গেলেন। সেদিক থেকে বলতেই হয়, মমতা ব্যানার্জীর প্রার্থী নির্বাচন তারিফযোগ্য। মুখ্যমন্ত্রীর তালিকায় কিছু রাজনৈতিক নেতা নেত্রীর পাশাপাশি বিনোদন জগতের মানুষরাও ছিলেন। জুন মালিয়া, সায়নী ব্যানার্জী, রচনা ব্যানার্জী,শতাব্দী রায়, দেব প্রমুখ অভিনয়ের অঙ্গন ছেড়ে এসে রাজনীতির অঙ্গণেও জয়ের পতাকা ওড়ালেন।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বারবার ছুটে এসেছেন বাংলায়। মমতা ব্যানার্জীও কঠোর পরিশ্রম করেছেন। একটার পর একটা সভায় ছুটে গেছেন।বক্তব্য রেখেছেন নিজস্ব ভঙ্গিমায়। সেই ভঙ্গিমা আর জনমুখী প্রকল্পগুলি বিজেপির আশার তরী ডুবিয়ে দিল। অন্যদিকে নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহর ভিন্ন ভাষার বক্তব্য বিন্দুমাত্র প্রভাব বিস্তার করল না বঙ্গবাসীর মনে। বরং মুখ্যমন্ত্রীর সহজ সরল মেঠো ভাষার বক্তব্যেই মোহিত হয়েছে বঙ্গবাসী।তৃণমূল ছেড়ে এসে কোন ফয়দা তুলতে পারলেন না অর্জুন সিং, তাপস রায়, সজল ঘোষের মত লড়াকু নেতারাও।
বঙ্গে তাই থমকে গেল গেরুয়া ঝড়। বরং ঝড়ের রঙ বদলে গেল সবুজ আবিরে। সামনে বিধানসভা নির্বাচন। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই জয় তৃণমূলকে প্রচুর অক্সিজেন যেমন জোগালো, তেমনি অক্সিজেনের অভাবে শ্বাসকষ্ট শুরু হল বিজেপি দলের।