নামের খোঁজে : রাঢ় থেকে বীরভূম

উত্তম মণ্ডলঃ

খ্রিস্টিয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর ঐতিহাসিক মিনহাজউদ্দিনের “তবকৎ-ই-নাসিরী” থেকে জানা যাচ্ছে, খ্রিস্টিয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমমার্ধ পর্যন্ত গঙ্গার পশ্চিম ভূ-ভাগের নাম ছিল “রাঢ়।” এরপরই খ্রিস্টিয় চতুর্দশ শতাব্দীতে মহেশ্বরের কুলপঞ্জিকায় দেখা যাচ্ছে, “বীরভূ: কামকোটী স‍্যাৎপ্রাচ‍্যাং গঙ্গাজয়ান্বিতা”, অর্থাৎ এই খ্রিস্টিয় চতুর্দশ শতাব্দীতে এসে রাঢ়ের নাম হয়ে গেল “বীরভূম।” কামকোটী বা কল্পভূমি বীরভূম। আর এই মহেশ্বরের কুলপঞ্জিকা অনুসারে, কামকোটী বীরভূমের ভৌগোলিক অবস্থানটা হলো “আরণ‍্যকং প্রতীচ‍্যন্তু”, অর্থাৎ এর পশ্চিম অঞ্চল জুড়ে রয়েছে অরণ্য। এই অরণ্যভূমি নি:সন্দেহে হলো “ঝাড়খণ্ড।” “ঝাড়ি” বা “ঝাড়” শব্দের অর্থ “অনেক।” আজও আমরা ঝোপঝাড়, বাঁশঝাড় বলতে অনেক ঝোপ, অনেক বাঁশ বুঝি। তাই অনেক রকম গাছপালা ঘেরা জঙ্গলের দেশ বলে এলাকার নাম “ঝাড়িখণ্ড” বা “ঝাড়খণ্ড।”
মহাকাল সংহিতায় আমরা দেখতে পাচ্ছি,—“ঝাড়িখণ্ডে বৈদ‍্যনাথো বক্রেশ্বরস্তথৈবচ”, অর্থাৎ, ঝাড়িখণ্ডে রয়েছেন বৈদ‍্যনাথ ও বক্রেশ্বর। সুতরাং, বোঝাই যাচ্ছে, রাঢ়ের এই জঙ্গল মহলের নাম ছিল “ঝাড়খণ্ড” এবং তখন বীরভূম নামটিও চালু ছিল। খ্রিস্টিয় ষোড়শ শতাব্দীর রচনা “চৈতন্য চরিতামৃত” গ্রন্থে আমরা দেখতে পাচ্ছি, শ্রীচৈতন্য কাশী যাচ্ছেন এই ঝাড়খণ্ডের পথেই। তাই বলা যায়, রাঢ়, ঝাড়িখণ্ড ও বীরভূম–তিনটি একই এলাকার স্থাননাম। দেখা যাচ্ছে, ঝাড়খণ্ডেরই পরবর্তীকালে নাম হয়েছে “বীরভূম।” এই ” বীরভূম” নামকরণ দেখা যাচ্ছে মহেশ্বরের কুলপঞ্জিকা অনুসারে খ্রিস্টিয় চতুর্দশ শতাব্দীতে। কিন্তু আবার আমরা “চৈতন্য চরিতামৃত” গ্রন্থে খ্রিস্টিয় ষোড়শ শতাব্দীতে “ঝাড়খণ্ড” নাম পাচ্ছি। এ থেকে বোঝা যায়, খ্রিস্টিয় চতুর্দশ শতাব্দীতে রাঢ়ের “বীরভূম” নামকরণ হয়ে গেলেও খ্রিস্টিয় ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত পাশাপাশি পুরোনো নাম “ঝাড়িখণ্ড” চালু ছিল। তার আগে খ্রিস্টিয় দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত এর নাম ছিল “রাঢ়।”
গবেষক প্রণব রায় ১৯৮৫ সালে মেদিনীপুরের চন্দ্রকোণা থানার মাধবপুর থেকে একটি প্রাচীন টুকরো শিলালিপি আবিষ্কার করেছেন, তার আংশিক পাঠোদ্ধারে জানা যাচ্ছে, ১১০৪ খ্রিস্টাব্দে ( ৩৬৮ ভৌমকর অব্দ) সেখানে একটি শিবমন্দির তৈরি হচ্ছিল এবং সেখানে বঙ্গদেশ থেকে আনা একটি বড়ো শিবমূর্তি “রাঢ়াশ্রী” বিশেষণে ভূষিতা (নামটি মুছে গেছে) এক মহিলা প্রতিষ্ঠা করেন।–তথ্যসূত্র : প্রাচীন বাংলায় শিলা ও তাম্রলিপিতে সমাজ ও সংস্কৃতি, ড: রতিকান্ত ত্রিপাঠী, কলকাতা, ২০১২, পৃ: ২২৫.
এ থেকে প্রমাণিত, খ্রিস্টিয় একাদশ শতাব্দীতে “রাঢ়” নামটি গৌরবের সঙ্গে বহুল প্রচলিত ছিল। ভারতীয় যাদুঘরে রাখা তাম্রপত্র “দ‍্য গঙ্গা ইয়ার ৩০৮”-এ উত্তর রাঢ়ের উল্লেখ আছে। বেলাভ ও নৈহাটি তাম্রশাসনে “রাঢ়” জেলার নাম পাওয়া যাচ্ছে (Ep Indica, xxiii-74)। আবার লক্ষ্মণসেনের শক্তিপুর প্রশস্তিতে (Ep Indica, xxx-211) দেখা যাচ্ছে, উত্তর রাঢ় মণ্ডল মুর্শিদাবাদের কান্দি মহকুমার কিছু গ্রামকে বেষ্টন করে রয়েছে।
পাল রাজত্বের শেষদিকে বাংলা অসংখ্য ছোট ছোট রাজ‍্যে বিভক্ত হয়ে যায় এবং সমগ্র দেশ নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা ও অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হয়। রামপালের মৃত্যুর কিছু পরে বিজয় সেন বাংলায় স্বাধীন রাজ‍্য প্রতিষ্ঠা করে বাংলাকে চূড়ান্ত বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করেন। দেওপাড়া শিলালেখ অনুসারে, বিজয় সেন নান‍্য, বীর, রাঘব ও বর্ধনকে পরাজিত করেন। নান‍্যদেব ছিলেন মিথিলার রাজা, বাকিদের পরিচয় অজানা। প্রাচীন জৈন গ্রন্থ “আচারঙ্গ সূত্র” অনুসারে, পশ্চিমবঙ্গের নাম ছিল “রাঢ়।” খ্রিস্টিয় দ্বাদশ শতাব্দীর পূর্বে “বারেন্দ্র” কথাটি জানা ছিল না। লক্ষ্মণ সেনের প্রধান বিচারপতি হলায়ূধ মিশ্র রচিত “ব্রাহ্মণ সর্বস্ব” গ্রন্থে সর্বপ্রথম “রাঢ়ী” ও “বারেন্দ্র” নামে দুটি আলাদা আলাদা ব্রাহ্মণ গোষ্ঠীর উল্লেখ দেখা যাচ্ছে।
যাই হোক, ঝাড়িখণ্ড বা ঝাড়খণ্ডে যে বহু রকমের গাছ-গাছালি ও পশুপাখি পরিবেষ্টিত জঙ্গল ছিল, তার উল্লেখ দেখা যাচ্ছে, গুপ্তযুগের লেখা স্কন্দপুরাণের মাহেশ্বর খণ্ডে,–“অস্তি ব‍্যাঘ্রপুরং নাম তিল্লিকাননমধ‍্যগম্ । / যত্র নৃত্যন্তমীশানাং পর্যু্পাস্তে পতঞ্জলি:।/ শ্বেতারণ‍্যমিতি স্থানমুক্তং তব ময়াপুরা।” অর্থাৎ, তিল্লিকাননের অন্তর্গত ব‍্যাঘ্রপুর নামক স্থানে নৃত্যরত ঈশান রয়েছেন। এর পুজো করেছিলেন পতঞ্জলি। সেখানে ব‍্যাঘ্রপুর-ই হলো শ্বেতারণ‍্য। উল্লেখ্য, এখানে তিল্লিকানন, ব‍্যাঘ্রপুর, শ্বেতরণ‍্য নামগুলি নি:সন্দেহে এলাকার জঙ্গল মহলের সাক্ষ‍্য দেয় এবং সে জঙ্গল এতটাই গভীর ছিল যে, সেখানে বাঘেদের অবাধ বিচরণক্ষেত্র “ব‍্যাঘ্রপুর” ছিল। পরবর্তীকালে উইলিয়াম উইলসন হাণ্টার তাঁর “অ্যানালস্ অব্ রুরাল বেঙ্গল” গ্রন্থে ঝাড়খণ্ডে “শেরঘাঁটি” বলে একটি স্থানের নাম উল্লেখ করেছেন। “শের” অর্থাৎ বাঘেদের “ঘাঁটি” ছিল বলেই এই নাম। সুতরাং , এবার ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন জঙ্গল এলাকার অস্তিত্ব প্রমাণ হয়েই যায়। তাহলে বোঝা গেল, “রাঢ়” থেকে ” ঝাড়খণ্ড” এবং সব শেষে এ মাটির নাম হয়েছে “বীরভূম।” “বীরাণাং ভূ:”, বীরদের ভূমি , তাই “বীরভূমি”, ” দ‍্য হিরো ল‍্যাণ্ড।”…
এখন পশ্চিমবঙ্গের একটি অন্যতম জেলা এই বীরভূম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *