কে বলে গো নেই তুমি

তীর্থকুমার পৈতণ্ডীঃ

২৮ জানুয়ারী, ভোর ৬টা। নয়াপ্রজন্ম পত্রিকার জন্মলগ্নের সাংবাদিক সনাতন সৌ-এর ফোনটা পেয়ে থমকে গেলাম। মহানক্ষত্র পতন ঘটল বীরভূমের বুকে। বীরভূমের একাই ১০০ কাঞ্চন সরকার তাঁর কর্মযজ্ঞ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। কারও লাল চোখ, যাকে তাঁর জিদ থেকে একচুল সরাতে পারতো না –মৃত্যু তাঁকে থামিয়ে দিয়ে গেল চিরকালের মতো। ফিরে যাই অনেকগুলো বছর। কাঞ্চনদার সঙ্গে আমার পরিচয় সেই ১৯৯২ সালে। তাঁর সঙ্গে প্রথম মুখোমুখি দেখা পরেরবছর ২৩ জানুয়ারি, টিকাপাড়ার গলির ভিতর নয়াপ্রজন্ম দপ্তরে বার্ষিক সাংবাদিক সভায়। সেদিন থেকেই আমরা তাঁর সহযোদ্ধা। তারপর কেটে গেছে ৩০টা বছর। দীর্ঘ ৩ দশক। সেই গলির ভিতর সম্পাদকীয় দপ্তরে পাটাতনের উপর বসে কাগজ ভাঁজ করা রবিদা, সনাতনদার সঙ্গে বইমেলা, নেতাদের লালচোখে, হুমকি, একাধিক মামলা, হাজত বাস, টিকাপাড়ার গলি থেকে নিজস্ব দপ্তরে উঠে আসা। চার পাতা থেকে ষোলো পাতার রঙিন পত্রিকা–– অসংখ্য বিশেষ সংখ্যা––সংবর্ধনা-সম্মাননা, রাষ্ট্রপতির সংবর্ধনা, উৎসব-অনুষ্ঠান, সবুজের অভিযান, নবজাতক স্কুল, বসুন্ধরা মঞ্চ আরও কতো কী! সেই প্রথম দিন থেকেই সবকিছুর সাক্ষী আমি, আমরা। মাথার উপর বইয়ে গেছে অনেক ঝড়ঝাপটা। তবু মেরুদণ্ড সোজা রেখে সামনে থেকে লড়াই করেছেন আমৃত্যু। চিরনবীন, চিরযুবক। একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম—আপনি তো সবাইকে নিয়ে লিখলেন, অনেককে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা করলেন, আপনাকে নিয়ে কে লিখবে? কে করবে বিশেষ সংখ্যা? স্বভাবসিদ্ধ ভাষায় বললেন, কেন তোমরা তো আছো। কাঞ্চনদা আমি কি লিখতে পারি? ডোবার চুনোপুটি কি সাগরের বর্ণনা করতে পারে? যিনি সব্যসাচী—যার হাত আর মুখ সমান চলে তাঁর কথা লেখার সাধ্য আমার নেই। কর্মযোগী কাঞ্চনদা জেলার সাংবাদিক মহলে এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। আমার বিচারে জেলায় সেরা। জেলার সংবাদপত্র জগতে তিনি এক নতুন ধারার প্রবর্তন করেছেন। সংবাদ-সাহিত্য এবং সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। নিজের হাতে তৈরি করেছেন অসংখ্য সাংবাদিক যাঁরা পরবর্তীকালে স্বনামেই খ্যাতিমান। এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র শহরে যাঁর বাস, কর্মের বিস্তার তাঁর বহুদূর। জেলাসদর থেকে অনেক দূরে ঝাড়খণ্ড ঘেঁষা আমার গ্রাম। কি সংবাদ, কি সাহিত্য কোনো তালিকাতেই যাঁর কোন অস্তিত্ব চিল না। তেমনই এক গ্রাম থেকে আমার উঠে আসা। সেই আমাকে পরিচিতি দিয়েছে নয়াপ্রজন্ম। পেয়েছি নাম-যশ-পরিচিতি-সম্মান-সংবর্ধনা এবং ভালোবাসা। যার নেপথ্যে সেই কাঞ্চন সরকার। পেয়েছি তাঁর দরাজ সার্টিফিকেট ‘নয়াপ্রজন্মের স্যাটেলাইট’। বছর শেষে ফিরে দেখা লেখার জন্য এই সম্মান। তাও আবার বসুন্ধরা মঞ্চে বিশ্বভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য সুজিত বসুর হাত থেকে সংবর্ধনা নেওয়ার মুহূর্ত। যাঁর কাছ থেকে এতো কিছু পেয়েছি বিনিময়ে তাঁকে কী দিলাম! হ্যাঁ দিলাম। নয়াপ্রজন্ম’র পক্ষ থেকে সাদা রজনীগন্ধার বড় মালা তাঁর মৃতদেহে তুলে দিলাম। তিনি চেয়েও দেখলেন না। এমন তো আগে হয়নি। যিনি ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতে পারেন তিনি নীরব। নীরবে চলে গেলেন বড়ো অসময়ে। কাজপাগল মানুষটা যদি নিজেকে একটু ভালোবাসতে পারতেন তাহলে হয়তো এইভাবে চলে যেতে হতো না।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *