জীবন-জীবিকাঃ বীরভূমের তাঁতিপাড়ার তাঁত শিল্প ও শিল্পীদের উন্নয়নে নয়া উদ্যোগ: “রেশম প্রয়াস” প্রকল্পে যন্ত্রের সাহায্যে তসরগুটি থেকে সুতো উৎপাদনের প্রশিক্ষণ কর্মশালা শুরু হলো

শম্ভুনাথ সেনঃ

“পরে তসর, খায় ঘি” তাঁর আবার ভাবনা কি! এমন প্রবাদ বাক্য এখনো গ্রামের মানুষের মুখে মুখে ঘোরে। আসলে তাঁতে বোনা তসরের পোশাক আলাদা আভিজাত্য এনে দেয়। বীরভূমে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ তাঁতশিল্পের সঙ্গে যুক্ত। তবে রাজনগর ব্লকের তাঁতিপাড়া গ্রামে তন্তুবায় পরিবারের বাস জেলার বুকে সবচেয়ে বেশি। গ্রামের এক হাজার তন্তুবায় পরিবারের মধ্যে অধিকাংশ পরিবার আজও পরম্পরায় ধরে রেখেছে তাঁতের কাজ। তাঁতই তাঁদের জীবন-জীবিকা। তাঁতিপাড়া গ্রামে ঢুকলেই শোনা যায় মাকুর ঠকাঠক শব্দ। সকাল থেকেই পরিবারের ছেলে-মেয়ে সবাই মিলে লেগে পড়ে তাঁতের কাজে। মেয়েরা থাই রিলিং এ তসর গুটি থেকে সুতো তৈরি করে, কেউবা লাটাই এ গুটোয় সুতো, আবার কেউবা বোনে তাঁত। আজও হস্তচালিত তাঁতে বোনা কাপড়ে তৈরি হয় তসরের শাড়ি, ধুতি, সালোয়ার সুট, দোপাট্টা, পাঞ্জাবি অনেক কিছু। এইসব কাপড়ের মূল উপাদান তসর ও রেশমের গুটি। বীরভূমের রেশম ও তসর গুটি উৎপাদনের জন্য দুবরাজপুর ব্লকের পন্ডিতপুর, মহম্মদবাজার, বোলপুরের মুলুক, শ্রীনিকেতন এমন জেলার ৮ টি জায়গায় নির্মাণ হয়েছে সরকারি খামার। সেখানে যেমন তসরগুটি উৎপন্ন হয়, তেমনি শিল্পীদের দেওয়া হয় প্রশিক্ষণ। এখন আবার তাঁতে বোনা কাপড়ে নানান রং তুলির কাজ করে চাহিদা উপযোগী করে তুলছেন শিল্পীরা। তাঁতিপাড়ার হাতে বোনা তাঁতের শাড়ির সুনাম রয়েছে যথেষ্ট। তাঁতের কাপড়ের চাহিদা রয়েছে দেশ-বিদেশে। এলাকার অনেক শিল্পী সরকারি সাহায্যে বিনামূল্যে পেয়েছেন তাঁতযন্ত্র। তাঁতীপাড়ার এই তাঁত শিল্প ও শিল্পীদের স্বনির্ভর করার লক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের “রেশম প্রয়াস” প্রকল্পের অন্তর্গত প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। গত ৬ জুলাই তাঁতীপাড়ায় এই প্রশিক্ষণ কর্মশালার উদ্বোধন করেন বীরভূম জেলা পরিষদের সভাধিপতি তথা বিধায়ক বিকাশ রায় চৌধুরী। আগেই এই তাঁতিপাড়ায় তিন একর জায়গার উপর বহু ব্যয়ে গড়ে উঠেছে খাদি ভবন। এদিন উপস্থিত ছিলেন বীরভূম জেলা সমাহার্তা বিধান রায়, অতিরিক্ত জেলাশাসক কৌশিক সিনহা সহ সংশ্লিষ্ট খাদি, হ্যান্ডলুম, রেশম দপ্তরের ঊর্ধ্বতন আধিকারিকরা। ছিলেন স্থানীয় রাজনগর পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ সুকুমার সাধু, তাতিপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান মলয় রায় প্রমুখ। স্বনির্ভর দলের ২৫ জন মহিলা এই প্রশিক্ষণ নেবেন। ২০ দিন ধরেই চলবে এই প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণের যাবতীয় খরচ বহন করবে বীরভূম জেলা পরিষদ। অন্যদিকে জেলার সেরিকালচার দপ্তর সরবরাহ করেছে “বুনিয়াদ” ও “উন্নতি” এই দু ধরনের ১২ টি মেশিন। বিদ্যুৎ ছাড়াও সৌরশক্তিতে এই মেশিন চালানো যাবে। এতথ্য জানিয়েছেন রেশম দপ্তরের জেলা উপ-অধিকর্তা ডঃ তপন মুখোপাধ্যায়। প্রসঙ্গত বলা যায় আগে সেই গতানুগতিক পদ্ধতিতে বাড়ির মেয়েরা থাই রিলিঙের সাহায্যে তসরগুটি থেকে সুতো উৎপাদন করতো। এখন এই মেশিনে সুতো তৈরি হলে যেমন কম সময়ে বেশি সুতো উৎপাদন করা যাবে তেমনি গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে বাঁচবে মেয়েদের সম্ভ্রম। এখানকার তৈরি এই সুতো আগামী দিনে তন্তুজ দপ্তর কিনে নেবে। দুটো বাড়তি লাভের মুখ দেখবে এই স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা। পাশাপাশি বেঁচে থাকবে তাঁত শিল্প, তাঁতশিল্পীরা পাবে জীবিকার দিশা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *