বীরভূমের বক্রেশ্বরে ধর্মঠাকুর পুজো পান মা কালী রূপে

উত্তম মণ্ডলঃ

প্রত্নযুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত বীরভূমে ক্ষেত্র-অনুসন্ধান করলে জানা যায়, বহু ক্ষেত্রেই এখানে দেবদেবীদের রূপ বদল ঘটেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই বদলটা এমনভাবে ঘটেছে, যেখানে পুরুষ দেবতা পরিণত হয়ে গেছেন স্ত্রী দেবতায় আর জৈন তীর্থঙ্করদের মূর্তিগুলো রূপান্তরিত হয়ে “ভৈরব” নামে পুজো পাচ্ছেন, কোথাও আবার গৌতম বুদ্ধ হয়ে গেছেন “ধর্মঠাকুর”, এমনকি, কোথাও আবার দেবাদিদেব শিবের লিঙ্গমূর্তি পূজিত হচ্ছেন “ধর্মঠাকুর” হিসেবে। বাংলার রাজধর্ম বদলের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের উপাস‍্য দেবদেবীদেরও এই এই বিচিত্র রূপ বদল ঘটেছে। এই চমকপ্রদ বিষয়টি নিয়েই এই আলোচনা।

শুরুতেই সবিনয়ে জানাই, এই ক্ষেত্র-অনুসন্ধানে আমার ভূমিকা শুধুমাত্র একজন নিরাসক্ত ইতিহাস-পথিকের, কারো ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করা আমার এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমি শুধু জেলার লোকসংস্কৃতির এক অনালোচিত অধ‍্যায় নিয়ে আলোচনা করছি। ঐতিহাসিক ডি.ডি. কৌশাম্বী তাঁর “দ‍্য কালচার অ্যাণ্ড সিভিলাইজেশন অব্ এনসেন্ট ইণ্ডিয়া” ( দিল্লি, ১৯৮২) গ্রন্থে বলছেন,—“বিভিন্ন ধর্মীয় ইতিহাসের আড়ালে সমাজের রূপান্তরের ইতিহাস আবিষ্কার করতে পারলে তবেই সত্যিকারের ইতিহাস রচিত হতে পারে।” অন‍্যদিকে, সমাজতত্ত্ববিদ্ ম‍্যাক্স ওয়েবার ( Max Weber)ও তাঁর “রিলিজিয়ন অব্ ইণ্ডিয়া” (১৯৬১) গ্রন্থে জানাচ্ছেন,—“বিভিন্ন ধর্মীয় আন্দোলনের ভেতর দিয়েই সমাজের পট পরিবর্তন ঘটেছে।” একালে মানুষ যেমন আয়ারাম গয়ারামের মতো রাজনৈতিক দল বদল করে থাকে, তেমনিভাবে প্রাচীনকালে মানুষ তাদের ধর্ম বদল করেছে। ব্রাহ্মণ‍্যধর্মাবলম্বী থেকে কখনও বৌদ্ধ এবং পরবর্তী সময়ে বৌদ্ধ থেকে মুসলমান পর্যন্ত হয়েছে। আর এই ধর্ম বদলের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ তাদের চাহিদা অনুযায়ী দেবদেবী “তৈরি” করেছে। এই দেবদেবীরা প্রায় সকলেই লৌকিক দেবদেবী। কোথাও আঞ্চলিক দেবতা, আবার কোথাও গ্রামদেবতা হিসেবে এইসব দেবদেবীরা তাঁদের “থানে” (স্থান) আজও পুজো পাচ্ছেন। এই উপলক্ষে মেলাও বসে কোথাও কোথাও এবং গড়ে ওঠে মাটির ঘোড়া, চাঁদমালা, বাতাসা, কাঠের খড়ম, ত্রিশূল, গাঁজার কলকেসহ বিভিন্ন ধাতু, মাটি ও পাথর থেকে তৈরি লোকশিল্প। এসব লোকশিল্পীরা সাধারণত ঐসব দেবদেবীর গ্রামে বা আশেপাশের গ্রামে বসবাস করে থাকেন এবং বংশপরম্পরায় তাঁরা এসব শিল্প সামগ্রী তৈরি করে আসছেন।

বীরভূম তথা রাঢ়-বাংলার অন‍্যতম লৌকিক দেবতা হচ্ছেন ধর্মঠাকুর। এই ধর্মঠাকুর কিভাবে রূপ বদল করে মা কালী হয়েছেন, এ লেখায় সেই চমকপ্রদ বিষয়টি নিয়েই আজ আলোকপাত করবো। সেটি দেখতে আমাদের যেতে হবে এই জেলারই দুবরাজপুর থানার গোহালিয়াড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত প্রখ্যাত শৈবক্ষেত্র বক্রেশ্বরে। বক্রেশ্বর মোড় থেকে চলে আসুন বক্রেশ্বর নদীর পাড়ে মহাশ্মশানে। মহাশ্মশান ছাড়িয়ে বক্রেশ্বর নদী পেরিয়ে চলুন যাই বক্রেশ্বর নদীর অপর পাড়ে। এখানে দেখতে পাবেন, খানিকটা ঝোপ-জঙ্গলের আড়ালে অবস্থিত একটি সিমেন্ট বাঁধানো বেদি। বেদির ওপর সিঁদুর মাখানো পাথর, যা বর্তমানে দেবী কালী বলে পুজিতা হচ্ছেন। লোকেরা জায়গাটার নাম দিয়েছে “ঝুপোকালীর থান।” ঝোপঝাড়ের জন‍্যই এই নাম। কিন্তু একটু অনুসন্ধিৎসু চোখ নিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবেন, এটি আসলে একটি ধর্মঠাকুরের স্থান। ছোটবেলায় দেখেছি, এখানে রক্তবস্ত্র পরিহিত কালো বেঁটেখাটো চেহারার এক ন‍্যাড়ামাথা সন্ন্যাসী বসবাস করতেন। লোকমুখে তাঁর নাম ছিল “যোগেন সাধু।” আশেপাশের গ্রামগুলোতে ভিক্ষে করে বেড়াতেন। একটি ছোট্ট পিতলের বালতি ছিল তাঁর। অন্য হাতে থাকতো একটি ত্রিশূল। গৃহস্থের উঠোনে পিতলের বালতিটি পেতে দিয়ে বলতেন, “হরে রামকৃষ্ণ! মা, ভিক্ষা পাই।” এরপর বালতিতে ভিক্ষার চাল জমা হতো। এই যোগেন সাধুই কোনো কিছু না জেনে এখানকার ধর্মঠাকুরকে “মা” “মা” বলে ডাকতেন আর এখানেই থাকতেন। সেই থেকে ধর্মঠাকুর হয়ে গেলেন মা কালী। বর্তমানে মানুষজন তাঁর নতুন নামকরণ করেছেন “ঝুপোকালি।” একটু ভালো করে দেখলেই বোঝা যায় বিষয়টা। আসলে ধর্মঠাকুরের মূর্তিগুলো হচ্ছে বৌদ্ধস্তূপের অনুকরণে তৈরি। হিন্দুদের শিবলিঙ্গের সঙ্গে এই বৌদ্ধস্তূপের মৌলিক পার্থক্যটা হলো, শিবলিঙ্গের অবস্থান গৌরীপাটে বা পীঠিকায়। অন‍্যদিকে, বৌদ্ধস্তূপে এই গৌরীপাট নেই। সুতরাং, যোগেন সাধুর মা কালীর মূর্তিটি হচ্ছে একটি গৌরীপাটশূন‍্য বৌদ্ধস্তূপরূপী ধর্মঠাকুর! এবছরও কালীপুজোর রাতে এই বৌদ্ধস্তূপরূপী ধর্মঠাকুর ভক্তদের হাতে পুজো পেলেন মা কালীরূপে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *