কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি………….. বিদায় কাঞ্চন সরকার

আদিত্য মুখোপাধ্যায়ঃ

পরোপকার করতে করতেই ছেলেটা চলে গেল! নিজের কথা ভাবেনি কোনোদিন। সেভাবে গুরুত্ব দেয়নি নিজের অসুস্থতাকে। নিজেকে দেখলোই না নিজের মতো করে! ফলে কী হল? বীরভূমের স্বপ্ন-সাধ-সাহস কাঞ্চন সরকার অকালে চলে গেল। এমন বীরভূমপ্রেমী, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, বোধ-বুদ্ধি-উচ্চারণের নির্ভীক নির্ভরতার মানুষ আর রইল না বীরভূমে। আমার একসময়ের ছায়াসঙ্গী, বন্ধু-ভাই-পরামর্শদাতা, আমার ইন্দ্রনাথ ছিল কাঞ্চন। নয়াপ্রজন্ম প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, অকুতোভয় সাংবাদিক, বিশিষ্ট সঞ্চালক, অসম্ভব প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব কাঞ্চন সরকার। তার সঙ্গে ৩০-৩৫ বছর ধরে কতো স্মৃতি, কতো ভ্রমণ, কতো রাত্রিবাস। কতো লোকের কতোভাবে যে উপকার করে গেল কাঞ্চন তার হিসেব পাওয়া শক্ত। আমিই তো ২০০৭ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বেঁচে ফিরেছিলাম ওর জন্য, ওর জন্যই। সবাই আমাকে ফোন করেই জানতে চাইছে ওর খবর। কী খবর দেব আমি?

এই ২০২২-এর ৯ জানুয়ারী জন্মদিন গেল কাঞ্চনের। ৬০ পূর্ণ করে ঢুকেছিল সবে ৬১তে। স্বপ্নের সে ফেরিওয়ালা স্বপ্ন বিপণি সাজিয়ে রেখে গেল বীরভূমের জন্য। অসম্ভব ভালোবাসতো বীরভূমকে। বীরভূমের মানুষজনকে সম্মান জানাতে তার কোনো কুণ্ঠা ছিল না। অসম্ভব জেদী, একরোখা, রূঢ়বাক্। অপ্রিয় স্পষ্ট কথা সামনেই বলে দিতে ২মিনিট ভাবতো না। ফলে এমন কেউ ছিল না যার সঙ্গে ওর অশান্তি হয়নি। অশান্তির পরেও নিজেই ডেকে এনেছে তাকে, গুরুত্ব দিয়েছে, বারবার ফোন করেছে। এমন উদারসাহসী মানুষও কম জন্মায় পৃথিবীতে। এরা উল্কা, অসম্ভব বেগ নিয়ে পৃথিবীতে এসে আবার অসময়েই মিলিয়ে যায়। কাঞ্চনের কোনো বিকল্প হবে বলে আমি মনে করি না। তবু তার স্বপ্ন-সাধ-আশা পূরণে এগিয়ে আসতেই হবে জেলার ‘কাঞ্চনপ্রিয়’ ও প্রেমিকদের। এমনিতেই অসম্ভব ক্ষতি হয়ে গেল জেলাবাসীর না জানিয়ে অসময়ে কাঞ্চনের চলে যাওয়াতে। যে শূন্যস্থান তৈরি হল তা পূরণ হবার নয়। ছেলেটা নিজেও জানতো না এমনভাবে অকালে চলে যেতে হবে।

২৭ জানুয়ারি অনিল হেমব্রমকে সুস্থ করে তোলার জন্য কাঞ্চন নিজে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গিয়ে মিশন হাসপাতালে ভর্তি করেছে এই বিদ্যাপীঠের শ্রমিককে। ৫-৩০ বিকেলে একটি প্রাণবন্ত মানুষ গেল দূর্গাপুর। সিউড়ী থেকে নিজে ড্রাইভ করে। সেই কিনা রাত্রি ২-৩০ মিনিটে আর নেই! ভাবা যায় না কিছু! কোনো হিসেবই মেলে না। গত দু-সপ্তাহ থেকে অনেককেই ফোন করেছে কাঞ্চন—পত্রিকার একটি বোর্ড গঠন করার জন্য। তবে কি ও বুঝতে পারছিল? জানি না, বার বার ফোন করেছে আমাকেও। বুঝতে পারিনি তখনি শুরু হয়ে গেছে ওর অন্তর্দাহ।

অসম্ভব পরিশ্রমী কাঞ্চনের লড়াইকথা অনেকেই জানেন না। তার আমরাপালনের জীবন, চুরুলিয়ার কথা এবং প্রায় নিঃস্ব হয়ে সিউড়ীতে মায়ের আঁচল জুড়ে ভাড়াবাড়িতে স্বপ্ন দেখা। মা ছিল কাঞ্চনের শ্রেষ্ঠ অবলম্বন। পুরো পরিবারও নিঃসর্তে সমস্ত ত্যাগ করেছে কাঞ্চনের জন্য। তার ফলেই তিল তিল করে গড়ে উঠেছে, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অনেককিছু। সে আমলের বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে বাংলায় অনার্স পাস কাঞ্চন সাংবাদিক হিসেবে সারা রাজ্যেই প্রতিষ্ঠিত। ওর নিজের জন্য একটি কাজের অভাব হতো না কখনোই। যে কোনো একটি দৈনিকে অনায়াসে কাজ করতে পারতো, করেনি। শুধু বীরভূমকে ভালোবেসেই করেনি। স্বাধীন থাকতে চেয়েছিল সব সময়। এমন উল্কার মতো বেগ নিয়ে যারা পৃথিবীতে আসে তারা পরাধীনতা বরদাস্ত করতে পারে না, বেশিদিন থাকেও না পৃথিবীতে। কাঞ্চনকে নিয়ে আগামীতে আরও অনেক চর্চা হবে। তার কাজের মূল্যায়নেরও প্রয়োজন আছে। জেলাবাসী নিশ্চয় তার অভাব বোধ করেই এগিয়ে আসবে এদিকে। তার অসম্পূর্ণ স্বপ্নগুলোকে সম্পূর্ণ করার কথা ভাবলেই বোধ হয় তার প্রতি সঠিক বিচার করা হবে। ও ভেবেছিল অনেক কিন্তু করে যেতে পারলো না। আসলে এমনভাবে আচম্বিতে চলে যেতে হবে, সেটাও একদমই ভাবেনি। সেই মণিমালা থেকে সবুজের অভিযান—নয়াপ্রজন্ম থেকে নয়াভুবন—শিশু পাঠশালা থেকে আনন্দ পাঠশালা—প্রকাশভূমি থেকে শেষতক বসুন্ধরা। একটি মানুষের পক্ষে এতো উদ্যোগ সম্পূর্ণ করা সহজ নয়। কাঞ্চনও সবটা সম্পূর্ণ করে যেতে পারলো না। তাহলে এবার কী হবে? নয়াপ্রজন্ম পত্রিকাটির না হয় সম্পাদক-প্রকাশক সবই করে গেছে কাঞ্চন। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলিরও নিশ্চয় কমিটি আছে, শিক্ষক-প্রধান শিক্ষক-সম্পাদক আছেন, কাঞ্চনের প্রিয়জন, বাড়ির লোকজনও আছেন। সবাই ভাবলেই একটা ব্যবস্থা হবে। দেখতেই হব, কাঞ্চনের স্বপ্নভঙ্গ যেন না হয়। অকৃতদার একটি মানুষ মানুষের উপকার করতে করতেই চলে গেল। নিজের কথা ভাবলো না কোনোদিন। কতো মানুষের কতো কথা শুনে লক্ষ লক্ষ টাকা সংগ্রহ ও ব্য়য় করে সাজিয়ে গেল বাগান। সে বাগানকে সজীব-সতেজ রাখার দায়িত্ব এখানেরই মানুষজনের। বলতে বাধা নেই, এমন নিঃস্বার্থ পরোপকারী বীরভূম-প্রেমী মানুষ এ জেলায় আর দুটি দেখিনি। বীরভূম তো নেই, সমগ্র বাংলাতেও নয়াপ্রজন্ম পত্রিকার মতো সংবাদ পত্রিকাও বিরল। ‘বসুন্ধরা’র মতো সর্বাধুনিক মঞ্চের স্বপ্নও তারই পক্ষে দেখা সম্ভব হয়েছে। হে বীরভূম জননী, তুমি কী হারালে তুমি তা জানো না!

স্যালুট কাঞ্চন সরকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *