নয়াপ্রজন্ম তর্পণঃ
জনমত তৈরী করা বা জনজীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকার দায়িত্ব সংবাদমাধ্যমের আবশ্যই। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের কোনো প্রতিনিধি যখন একটি জেলার জনজীবনে অনেক জননেতার থেকেও বেশি এবং বহুমুখী ভুমিকা নেন তখন সেই জেলার মাটি কাঞ্চনকৌলিন্য পেয়ে যায়। এমন নজির আর কোথাও আছে বলে আমরা শুনিনি। তাই কাঞ্চন সরকারের চলে যাওয়াটা যতই অসময়ে মনে হোক, সেটা সবসময় শূন্যতা। কারণ মানুষের সুখে-দুঃখে, সম্মান-অবহেলায় এরকম সক্রিয় ভূমিকা ওঁর আগে বা পরে আর কেউ নিতে পেরেছেন বা পারবেন বলে আন্তরিকভাবে বিশ্বাস হতে চায় না। মানুষটি আজীবন বিদ্রোহী ছিলেন বীরভূমের গায়ে সেঁটে থাকা একটি তকমার বিরুদ্ধে–পিছিয়ে পরা জেলা। তাই জেলাকে সবদিক থেকেই এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি যে শুধু সাংবাদিক সুলভ কলম ধরেছিলেন তা নয়, সত্যিকারের লাগাম ধরেছিলেন। তাই তাঁর আমন্ত্রণে সিউড়ীতে আসতে দ্বিধা করেননি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। আবার ভিনদেশী কয়েকজন অ্যাথলিট সিউড়ীতেই তাঁদের চমকপ্রদ কসরত দেখিয়ে যান কাঞ্চন সরকারের আয়োজনেই। এই চমক শব্দটা সবার ক্ষেত্রে মোটেই লাগসই নয়। কিন্তু কাঞ্চন সরকার জেলাকে বারবার চমকে দিয়েছেন তাঁর কর্মসূচীর বহুধারায়। বিখ্যাত এক ফিল্মি ডায়ালগের মতো বুক বাজিয়ে বলতেই পারতেন—আমি খবর তৈরী করি। যদিও এসবে বুক বাজানো নয়, বীরভূমবাসীর হৃদয় বারবার স্পর্শ করেছেন। সমসময়ের থেকে কতভাবেই যে এগিয়ে ছিলেন! তাই শিশুশিক্ষা থেকে সংস্কৃতির মঞ্চে যথার্থ আধুনিক সব পরিকল্পনার সার্থক রূপায়ণে নিজেকে সদা ব্যাস্ত রেখেছেন। আগামী প্রজন্ম তাঁর প্রত্যক্ষ সুফল বহুদিন ধরে পাবে। মানুষের বিপদে আপদে দায়িত্ব নেবার ভার আর কারো উপর ছেড়ে দেননি কখনো। যেন আদর্শ সাংবাদিকতাই। পরের মুখে ঝাল খাওয়া নয়, পরের হাতে রাশ তুলে দেওয়া নয়। তাই আহত মানুষকে চিকিৎসার জন্য অন্যত্র নিজের দায়িত্বে নিয়ে গিয়ে সেখানেই জীবনাবসান ওঁর জীবনের যথার্থ অন্তমিল। মানুষের জন্য এমন ভাবনা কোনো কালেই সুলভ নয়। উনি সেই দুর্লভ বৈশিষ্টের আদর্শ দৃষ্টান্ত ছিলেন। ওঁর বলিষ্ঠ লেখালেখি বা অসাধারণ বাগমিতা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। বলার কথা এটাই যে, এসবের জেরে অসততা-দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যাক্তিরা কিভাবে ওঁকে ক্রমাগত হেনস্থার চেষ্টা করেছে এবং সত্যের কাছে শেষ পর্যন্ত হেরে গিয়েছে। সাংবাদিকের তথা এমন ঘরনার মানুষের সত্যনিষ্ঠা সত্যি জীবনভর শেখার মতো। তিনিও বলতেই পারতেন–আমার জীবনই আমার বানী। এখনকার সংবাদমাধ্যমের অন্যতম কেতা গ্লামারের পিছনে দৌড়োনো। কিন্তু নয়াপ্রজন্ম বড়ো কাজ করেও চোখের আড়ালে থাকা বহু মানুষকে জনসমক্ষে এনে ফেলেছে এবং তুলে ধরেছে। বীরভূম যেকোনো দিকে সত্যি কোনোদিকে পিছিয়ে নেই বরং সত্যিকারের পিছিয়েপড়াদের দৃষ্টান্ত হতে পারে তা এঁদের নিয়ে লিখে কাঞ্চন সরকার বারবার প্রমাণ করেছেন। আমাদের এভাবে গর্বিত হবার সুযোগ এ জেলার আর কেউ কখোনো দিয়েছেন কি? শুধু এই কারণেই ওঁকে কখোনো ভোলা যাবে না। কতবার দেখেছি, ওঁর নামে কুৎসা রটাচ্ছেন অথচ তিনি বেশ কৃতী মানুষ এমন কাউকে ব্যক্তিগতভাবে কিছু বললেও তাঁর কৃতিত্ব কখনও কাগজে ছাপতে দ্বিধা করেননি। হৃদয়ের সাম্রাজ্য সুবিস্তৃত না হলে এটা অসম্ভব। তাই তাঁর চলে যাওয়াটা এই বিরল মানসিকতারও মৃত্যু। আলোর মতো নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন, ছায়ার মতো নিজেকে মেলে ধরেছেন। তাই মানুষটি কাগুজে মানুষ ছিলেন না কোনোভাবেই। অতএব গতানুগতিক শোকবার্তা লিখে তাঁর ঐতিহাসিক অবদানকে মাপার চেষ্টা করাই একটা ধৃষ্টতা। আমরা তাঁরই তৈরি করা পথে তাঁকে যথাসাধ্য তর্পণাঞ্জলির চেষ্টা করতে পারি মাত্র। এমন হৃদয়, মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডের সমন্বয়ে গড়া মানুষ চ্যালেঞ্জ নিতে পারার যে নজির সৃষ্টি করে গেলেন তার ধারক ও বাহক হওয়ার যোগ্যতা আমাদের নেই। শুধু তাকে অতি সীমিত সামর্থে অনুসরণ করার যতটুকুই হবে ওঁর প্রতি আমাদের অশেষ অভিবাদন। আয়ু কোনো না কোনো সময় শেষ হবেই। কিন্তু কাজ, চিন্তাধারা এগুলো তো ফুরোয় না। আর সেসবে যদি সার্থক উত্তরণ থাকে, বীরভূমের রাঙাধুলো কাঞ্চনকৌলীন্য পেয়ে থাকে তবে তো সেসব আক্ষরিক অর্থেই পথবাতি। ক্রমাগত এগিয়ে চলার দিকে উসকে দেয়। জানি অনেক “ইচ্ছেকুসুম” পূর্ণ বিকশিত কাঞ্চন হয়ে ওঠা বাকি থেকে গেল। তবু কিছু তো দায়িত্ব থেকেই যায়—মানুষের প্রতি, সময়ের প্রতি এবং অন্তরাত্মার প্রতিও। তাই নয়াপ্রজন্ম একই সঙ্গে পিতৃহারা ও মাতৃহারা হয়ে গেলেও উত্তরাধিকারের পবিত্র লড়াইটুকু কখনোই ছাড়বে না। কাঞ্চনবর্ণ ইতিহাস আমাদের প্রেরণা জোগাবে বরাবর। প্রণাম এবং কুর্ণিশ।