চন্দন চট্টোপাধ্যায়ঃ
বয়স মাত্র ঊনিশ! সঙ্গীতময় পরিবারের এই সর্বকনিষ্ঠা বর্তমানে সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজের সংস্কৃত অনার্সের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। কিন্তু এর মধ্যেই ‘সুকণ্ঠী’ হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছেন জেলা এবং চারপাশের এলাকায়। বেশ কয়েকটি সঙ্গীত প্রতিযোগিতার প্রথম স্থানও তাঁর করায়ত্ব। পৈর্তৃক ভিটে বীরভূম জেলার সদাইপুর থানার তাপাসপুর হলেও, বর্তমান বসবাস সিউড়ি সাজানোপল্লী। কিশোরী বয়স থেকে রাধাকৃষ্ণের অনুরক্ত কৃষ্ণাশ্রী গঁড়াই পরবর্তীতে ভক্তিগীতি তথা রাধাকৃষ্ণ লীলাকীর্তন কেই পেশা হিসাবে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন।
খ্যাতনামা শিল্পী শান্তব্রত নন্দনের কাছে তাঁর প্রথম ক্লাসিকাল গানের তালিম। তারপর সিউড়ির দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে প্রশিক্ষণের পর, বর্তমানে কলকাতার সলিল দাসের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সহ রবীন্দ্র-নজরুল-বাউল-লোকসঙ্গীত এবং কীর্তনের প্রশিক্ষণ চলছে গৌতম দাস বৈষ্ণব, সঞ্জয় বীরবংশী এবং কীর্তনীয়া পালাশ সরকারের কাছে। আধুনিক যুগের নতুন প্রজন্মের যুব সম্প্রদায় যখন ব্যান্ডের জগঝম্প এবং হিপ্পি-হিপ্পি উদ্দাম নাচের সংস্কৃতিতে গা ভাসিয়ে প্রগতিশীল হচ্ছে, সেখানে সরল, শান্ত, প্রাণখোলা মনের সদ্য তরুণী কৃষ্ণাশ্রী ভক্তিগীতির আবহে শ্রীকৃষ্ণলীলা কীর্তনে নিজেকে কেন্দ্রীভূত করে তুলছেন তরুণ প্রজন্মের কাছে এটা একটা প্রেরণা বইকি! “আমার প্রেরণা বলতে মা মিলি গঁড়াই, বাবা চন্ডিদাস গঁড়াই এবং দাদু গৌরচন্দ্র মণ্ডল। কীর্তনের ধারা হিসাবে ময়নাডালের মনোহরশাহী ঘরানাকেই বেছে নিয়েছি। আর কীর্তনকেই বেছে নেবার কারণ, কীর্তন গানে সম্মান মর্যাদা বেশী, উদ্দামতা বা উশৃঙ্খলতার কোনও জায়গা নেই। তৃপ্তি পাই।”– বললেন কৃষ্ণাশ্রী।
এই তৃপ্তি থেকে পরিতৃপ্তির লক্ষ্যে শখ, নেশা ও পেশাকে কেন্দ্র করে গড়ে তুললেন “রাধা গোবিন্দ কীর্তন সম্প্রদায়”, ২০১৭ সালে। ততদিনে কীর্তন জগতে তরুণ প্রজন্মের রমরমা। প্রবীন কীর্তনীয়ারা ক্রমশ কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। তাহলে কীর্তনে প্রকৃত ধারার উত্তরসূরি কি এই তরুণরাই? কৃষ্ণাশ্রীর কথায়, “বাস্তবিক অর্থে এটাই তো পরম্পরা। তবু বলবো, তরুণ প্রজন্মের এক বড়ো অংশের কীর্তনীয়াদের নিষ্ঠা, অধ্যায়ণ ও পরিশ্রম কম। ফেসবুক, ইউটিউবের দৌলতে অল্পসময়েই প্রচারের আলোয় উঠে আসছে। সস্তায় বাজীমাতের প্রবণতা বেড়েছে। নৈতিক চারিত্রিক অবক্ষয়ের কারণে কিছু কীর্তনীয়া কীর্তনজগৎকে কলুষিত করে তুলেছে। কিন্তু এভাবে স্থায়ী প্রতিষ্ঠা লাভ হয় না। টিকে থাকতে গেলে একটা নিজস্বতা থাকতে হয়”।
তাহলে এখনকার কীর্তন কি নিজস্বতা হারাচ্ছে? কৃষ্ণাশ্রীর বক্তব্য, “সবক্ষেত্রে না হলেও কিছুক্ষেত্রে কীর্তনের আঙ্গিক বদল আমার মনপুত নয়। নৃত্যের বৈচিত্র্য আনার জন্য কীর্তনে এখন লোকগীতির প্রভাব বাড়ছে। রবীন্দ্র-নজরুল সঙ্গীতের অন্তর্ভুক্তি ঘঠানো হচ্ছে। এই ধরণের আধুনিকীকরণ আমার কাম্য নয়।”
বীরভূম ছাড়াও কৃষ্ণাশ্রীর গান বর্ধমান, হুগলি, মুর্শিদাবাদ ও কলকাতার বিভিন্ন আসরে প্রভূত প্রশংসা অর্জন করেছে। গান ছাড়াও তিনি নাচেও যথেষ্ট পারদর্শী। সিউড়ির দেবযানী দত্তের কাছে শিখেছেন রবীন্দ্র নৃত্য ছাড়াও কত্থক ও মনীপুরী নৃত্য। ২০১২ সালে মাত্র ৯ বছর বয়সে রিলিজ করে তাঁর তিনটি সিডি। শিশু-কিশোর উপযোগী লোকগীতি নিয়ে ‘অ-এর পরে আ’, ভক্তিগীতির ‘সৎসঙ্গ ধামেতে’ এবং বাউলের ‘জয়দেবের মেলা’। এছাড়াও ২০১২ সালে আকাশবানীতে রেকর্ড করা হয় তাঁর দুটি আগমনী গান। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় তাঁর কৃতিত্ব যথেষ্ট আকর্ষনীয়। বাঁকুড়ায় অনুষ্ঠিত লোকগীতি প্রতিযোগিতায় (২০১২) প্রথম স্থান অর্জন করেন।
বীরভূমে আয়োজিত ২০১৯ সালে এক সর্বভারতীয় কীর্তন প্রতিযোগিতায় ব্লকস্তরে প্রথম এবং ‘সংস্কার ভারতী’-র পরিচালনায় সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় ২০১৪ সালে রবীন্দ্র, নজরুল ও লোকগীতি তিন বিভাগেই প্রথম হন। প্রথম স্থান পেয়েছেন ‘সৃষ্টি’ সংস্থার আয়োজিত সঙ্গীত প্রতিযোগিতাতেও ২০১৯ সালে।
কীর্তন জগতের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কৃষ্ণাশ্রীর অভিমত খুবই আশাবাদী। “করপোরেট কেন্দ্রিক চিন্তা ভাবনা ছাড়তে হবে। পুরোপুরি ব্যাবসায়িক হলেও চলবে না। কীর্তনের প্রকৃত মাধূর্য, বৈশিষ্ট ও মর্যাদাকে মেনে চললে কীর্তনের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।”
তাঁর নিজস্ব কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে চাইলে কৃষ্ণাশ্রী গঁড়াই- এর সপ্রতিভ উত্তর, “সারেগামাপা’য় অংশ নিতে চাই। চাই কিছু গান লিখতে এবং উপযুক্ত আর্থিক পরিকাঠামো পেলে একটি কীর্তন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়তে চাই।”