চন্দন চট্টোপাধ্যায়ঃ
আমি জীবনের সর্বশেষ সরস্বতী পূজা করিয়াছি অষ্টম শ্রেণিতে। তাহার পর এই পূজা বন্ধের কারণ কোনও নাস্তিক্যবাদ নহে, প্রাকৃতিক। সেইদিন হাড় কনকনানি শীতেও স্নান করিয়া পূজা করিতে হইবে, এই ফরমান লইয়া বাবার সহিত বিরোধ চরমে উঠিল। আজন্ম শীত কাতুরে আমার কাতর নিবেদন ছিল, সর্বাঙ্গে গঙ্গাজল ছিটাইলেই যখন পবিত্র হইয়া গেল, তখন স্নানের অপরিহার্যতা কী ! (বিশেষত তখনও পর্যন্ত ‘রাম তেরি গঙ্গা মৈলি’ শুরু হয় নাই)। শেষ পর্যন্ত রাগিয়া গৃহ নিষ্ক্রমণ, এবং মা সরস্বতীও সেই যে মাথায় উঠিলেন, তো আজিও উঠিলেন। অবশ্য তাহাতে আমার পড়াশোনার কোনও ক্ষতি বৃদ্ধি হইয়াছে বলিব না। অষ্টম শ্রেণিতে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হইলেও, গণিত এবং ইংরাজীর নম্বর যে টানিয়া ছেঁচড়াইয়া কোনোক্রমে দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছাইয়াছিল, তাহার জন্য দোষী মা সরস্বতী নহেন, ওই কেশব চন্দ্র নাগ আর পি. কে দেসরকার। গণিত এবং ইংরাজী যেন ইঁহাদের জমিদারি! যাহাই হউক, বালকবেলার শিহরণ জাগানো স্মৃতি গুলির মধ্যে সবচেয়ে জীবন্ত স্মৃতি হইল সরস্বতী পূজা। আমি তখন প্রথম শ্রেণি। সদ্য সদ্য মা সরস্বতীর সহিত পরিচয় ঘটিতেছে। রাত্রি জাগিয়া প্যান্ডেল তৈরি, অপহৃত আলু পোড়া লঙ্কা-লবণ সহযোগে। আর ভোর হইলেই সদলবলে অভিযান– মাঠ হইতে গমের শীষ, নগুড়ে কুল, আম ও জামের মুকুল, সর্বতি আলু, বাসক ফুল, শরকাঠি অপহরণ, পতাকা চিটানো, বাড়ি বাড়ি চাঁদা, পূজার দিন সকালে তারস্বরে ‘সরসত্যি মাইকি…’। ঠাকুর আনিতে যাওয়া, সরস্বতীর পদতলে অঙ্ক বই রাখা (নম্বর বাড়িবে), এবং পূজা শেষে ছল করিয়া বারংবার চিঁড়ে প্রসাদ গ্রহণ। কে কতবার প্রসাদ বাগাইতে পারিল বন্ধুরা মিলিয়া তাহার হিসাব নিকাশ…আহা, তখন কী সুন্দর দিন কাটাইতাম!
ক্রমে ক্রমে মনের ভিতর সরস্বতীর রূপ বদল হইতে লাগিল, খুঁত ধরিতে লাগিলাম। শুভ্রকান্তি তরুণ সকলের এত এত দেবদেবী ছাড়িয়া কেন মা সরস্বতীর সম্মুখেই হাতে খড়ি হইতেছে? মা সরস্বতী কি দেবকূলে সবচেয়ে বেশি শিক্ষিতা? কতদূর পড়াশোনা করিয়াছেন তিনি? ক্লাশে কি স্ট্যান্ড করিতেন? হাতে ওটা বীণা না হইয়া বহুল প্রচলিত বেহালা হইলেই বা কী ক্ষতি হইত? হাঁস কেন? হাঁস কি কথা বলিতে পারে? বাহন টিয়া বা ময়না হইলেই ভালো হইত, কারণ উহারা কথা বলিতে পারে। বাগদেবীর বাহন হইবে, আর কথা বলিতে পারিবে না, তাহা কোনোমতেই মানিতে পারিতাম না। পরিধানে শ্বেত বস্ত্র কেন, রঙবেরঙের হইলেই তো দেবীকে আরও সুন্দরী লাগিত!
তবে ততদিনে অবশ্য বয়সেই রঙ ধরিতে লাগিল! মনের একান্তে দেবীকে মানবী-মানবী মনে করিতে গিয়া কৌতুহলের পাশাপাশি কেমন যেন ভয়ও হইত। কিশোরী হইতে দেবী যেন ক্রমে ক্রমে হইয়া উঠিলেন যুবতী! দেবীর মৃন্ময়ী হইতে সরাসরি চিন্ময়ী রূপকল্প আমাদের হই-হই ভিতরে তখন চুপিসারে ডানা মেলিতেছে। পূজার দিন সদলবলে বিদ্যালয়ে বিদ্যালয়ে দেবীদর্শনে সবিস্ময়ে দেখিতাম, সেই মৃন্ময়ী কী সুন্দর চিন্ময়ী রূপে বিরাজ করিতেছেন চত্বরময়। তিনি এক হইতে বহু হইয়াছেন। একত্বের সরণি বেয়ে বহুত্বে স্বয়ং সম্পূর্ণা হইয়াছেন। পথঘাট সরস্বতীময়। মনময় এক অজানা সারস্বত প্রবাহ। অচেনা অজানা অথচ অপ্রতিরোধ্য এই হাওয়ায় মন ভিজিত বটে, আবার শিহরণও জাগিত। সেই প্রথম বুঝিতাম, এই শিহরণ শীতের শিহরণ হইতে সম্পূর্ণ পৃথক। এক অন্য ঋতুচক্র। বুঝিতে পারিলাম ‘মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো…।’ এই প্রাণখোলা ‘পাগলা হাওয়া’র আবহে নিঃশব্দে বাজিতে থাকিত ‘টুকরো করে কাছি, আমি ডুবতে রাজী আছি…।’
এবং ডুবিলামও। প্রেমে… সংসারে…অসাড়ে…। তাহাতে পরশমণি পাইলাম কি না পাইলাম বলিতে পারি না, তবে সরস্বতী পাইয়াছি। মাতৃ রূপেন, বনিতা রূপেন, জায়া রূপেন, সখী রূপেন, আত্মরূপেন, বহু রূপেন। তাহাতে আনন্দ, দুঃখ উভয়ই পাইয়াছি বলা যাইতে পারে। ফলতঃ জীবন যুদ্ধে যুগ্ম বিজয়ী হইয়া আজ এই যাই-যাই যৌবনেও মর্মে-মর্মরে শুনিতে পাইতেছি ‘আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে…’
এই আনন্দবোধই সরস্বতী পূজার মূল উপাচার। শ্রীপঞ্চমী যেন কুসুমিত প্রেমেরই এক পার্বন। এই পার্বনে সকল নারীই সরস্বতী। সকল নারীই সারস্বত-স্বরূপিনী। প্রতি বৎসর শ্রীপঞ্চমীর তিথি জুড়িয়া পূজিতা হন প্রেম, যাহা দেবী নহে, মানবী।