দীনবন্ধু দাসঃ
বীরভূম জেলার দক্ষিণপূর্ব প্রান্তে মুর্শিদাবাদ জেলার সংযোগ স্থলে সাঁইথিয়া বহরমপুর রাজ্য সড়কের লাগোয়া দক্ষিণে কোটাসূর গ্রাম আবার রামপুরহাট লাভপুর গামী পাকা রাস্তার উপরই কমলেশ্বর গ্রাম ও শিব মন্দিরের অবস্থান।
শিবতীর্থভূমি নামেই কলেশ্বর গ্রামের অধিক পরিচিতি। এই গ্রামে অনাদিলিঙ্গ দেবাদিদেব কলেশনাথ, মহাশক্তি পার্বতী, সর্বেশ্বর, কালভৈরব, চন্দ্রচূড়, রাজা রামজীবন প্রতিষ্ঠিত মা কালী, ষষ্ঠী মাতা, সাধক দ্বারিকানাথ দেব তপস্বী মন্দির এবং সাধু বাবার মূর্তি প্রতিষ্ঠিত। কলেশ্বরের চতুর্দিকে যোজন মধ্যে অবস্থান করছেন আদিশ্বর শিবলিঙ্গ মদনেশ্বর, রামেশ্বর, যোগেশ্বর, মল্লেশ্বর, ডাবুকেশ্বর, দণ্ডেশ্বর আদি দেবগণ। কলেশ্বরে কলেশনাথ নানা কিংবদন্তির আলো ছায়ায় আবৃত। কলেশ্বরের দক্ষিণ শিবপুর গ্রামে গোয়ালাদের বাসভূমি। গ্রামের কলেস গোয়ালার দুধের গাই প্রত্যহ অতি প্রত্যুষে জঙ্গলের দিকে যায়, কলেস কিছু দিন এটা লক্ষ্য করে, একদিন গাভীকে অনুসরণ করে জঙ্গলে গিয়ে লক্ষ্য করে গাভী একটি ঢিপির উপর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর তার বাঁটের থেকে আপনা আপনি দুধ ঝড়ছে। কলেস বিশ্বয়াবিভুত ও কৈতুহলান্বিত হয়ে ঢিবি খুঁড়তে শুরু করেন এবং একটি শিবলিঙ্গের সন্ধান পান। দেখা যায় শিবলিঙ্গের মাথা থেকে রক্ত ঝড়ছে। কলেস বুঝতে পারে অস্ত্রের আঘাতেই এই রক্ত পাত। দৈববাণী হ’ল এবং ঢেকার রাজা রামজীবন স্বপ্ননাদেশ পেলেন। জঙ্গল পরিষ্কার করে উদ্ধার হ’ল শিব লিঙ্গ, কলেস গোয়ালার প্রথম দর্শণের সূত্র ধরে শিবলিঙ্গের নাম হ’ল কলেসনাথ শিব। কলেস গোয়ালা ও তাঁর উত্তরসুরি বংশধরগণ দীর্ঘকাল কলেসনাথ শিবকে দুধের যোগান দিয়েছিলেন।
জনশ্রুতি এখানে কলাসুর ও বিল্বাসুর নামক দুই দৈত্যের বাস এক সময় দুই দৈত্যের মধ্যে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ বাঁধে তখন হরপার্বতীর মধ্যস্থতায় উভয় পক্ষের মধ্যে সন্ধি হয়। সন্ধির সর্তানুসারে কলাসুরের কন্যা কলাবতীর সঙ্গে বিল্বাসুরের পুত্র বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়। অবশ্য “চন্দ্রচূড় মাহাত্ম্য” পুথিতে কলেশ্বরকে মৎস্য দেশে অবস্থিত মায়াতীর্থ রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানেও রাজা রামজীবনের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রায় সাড়ে তিন’শ বছর পূর্বে রামজীবন কলেসনাথের আদেশ লাভ করে মন্দির নির্মাণ সম্পূর্ণ করেন। এমন সময় আকাশবাণী হয়- “গঙ্গাগর্ভে আছে এক লিঙ্গ মহাদেবে / সেই লিঙ্গ প্রতিষ্ঠায় আশির্বাদ হবে।” রাজা রামজীবন কলেশ্বরের অদূরে ঢেকায় রাজত্ব করতেন। তিনি নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ ও বীরভদ্রের সমসাময়িক ছিলেন। সে সময় ব্রাহ্মণ বিধবা রূপ যৌবন সম্পন্না স্বামীহারা শতাক্ষ্মী শিশুপুত্রকে নিয়ে মহা বিপদে পরলে, কাঠকুড়ানির ছদ্মবেশে মা পার্বতী দেখা দেখা দেন এবং তাঁদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে অবস্থান করেন। মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে শতাক্ষ্মী আগন্তুক বুড়ি কে দেখতে না পেয়ে ভয়ে কান্না করতে থাকলে বৃদ্ধের বেশে বাবা মহাদেব দর্শন দিয়ে অভয় দান করে বলেন – তোর পুত্র শতানন্দ কলেশ্বরের রাজা হবে। এ রূপ অনেক অলৌকিক কথার প্রচলন আছে। মন্দিরের অদূরে কুল কুল ধ্বনিতে প্রবাহমানা শিব গঙ্গা। তাতে ‘দেবীদহ ‘ নামে হ্রদের উৎপত্তি এবং তা দেবমহিমা মণ্ডিত। মন্দিরের চতুর্দিকে চারটি পুকুর বর্তমান। কলেশনাথ শিবের নিত্য পূজা ও ভোগ হয়ে আসছে এবং প্রতি বছর শিবচতুর্দশীতে ও শ্রাবণ মাসের প্রতি সোমবার উৎসব পালন হয়ে থাকে এবং প্রচুর মানুষের সমাগম হয়। গ্রামের এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে শিবভক্তের দল নর নারী, যুবক যুবতীগন বাঁক কাঁধে গঙ্গা জল নিয়ে এসে শিবের মস্তকে জল চাপান। এলাকা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের পুণ্যার্থী মানুষজন আগত পুণ্যার্থীদের বাবা কলেসনাথের প্রসাদ বসিয়ে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে থাকে।
গ্রামের উত্তর প্রান্তে স্বামী বিশাখানন্দ প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ আশ্রম। এই আশ্রমেই স্বামী বিশাখানন্দকে সমাধিস্থ করা হয়েছে। গ্রামের মাঝখানে রক্ষাকালী মাতার মন্দির। এছাড়াও চারখানা দুর্গা প্রতিমার পূজা ও উৎসব মহাধুমধামের সঙ্গেই হয়ে থাকে। এই চারখানা দুর্গার মধ্যে তিনটি পারিবারিক আর একখানা বারোয়ারি। শিব মন্দিরের ভিতরেই কার্তিক মাসের অমবস্যা তিথিতে কালী মায়ের পূজা হয়। এই মন্দিরে ইন্দ্রদেবের ও পূজা হয়ে থাকে। শিবচতুর্দশীতে এখানে একটি মেলা বসে থাকে তাতে ভালো বেচাকেনা হয়। মহাধুমধামের সঙ্গেই এই গ্রামে ‘ধর্মরাজ ‘ এর পূজা ও হয়ে আসছে। গ্রামখানি দেব দেউলে মুখরিত।