
সনাতন সৌঃ
সিউড়ী এক নম্বর ব্লকের অন্তর্গত খটঙ্গা পঞ্চায়েতের ভান্ডীরবন ধামের কাছেই বীরসিংহপুর একটি শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যশালী গ্রাম। দ্বাদশ শতকে রাজা বীর সিংহের রাজধানী ছিল এই বীরসিংহপুর গ্রামে। অবশ্য তাদের সেই রাজ প্রাসাদ এখন ধ্বংসাবশেষ স্তূপে পরিণত হয়েছে। মন্দির প্রাঙ্গণে সেই ভগ্নাদেশ নিদর্শন আজও দেখা যায়। বীরসিংহপুরে আছেন সেই বীর রাজার আরাধিত প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী মগধেশ্বরী কালী মন্দির। সেখানেই ৬০০ বছর সময় ধরে পুজিতা হয়ে আসছেন মগধেশ্বরী কালী মা। এই পুজোকে ঘিরে স্থানীয় জনমানসে অনেক লোককথা শোনা যায়। জানা যায় যে, মগধরাজ জরাসন্ধ বংশোদ্ভূত ক্ষত্রীয় যুবক বীর সিংহ ভাগ্য অন্বেষণে বঙ্গদেশে আসেন এবং বীরসিংহপুরে রাজধানী স্থাপন করেন। সঙ্গে নিয়ে আসেন তাঁদের কূলদেবী কালীকে। সে সময় এই অঞ্চলের প্রাণ পুরুষ ছিলেন রাজা বীর সিংহ। তিনি খুব কালী ভক্ত ছিলেন। প্রত্যহ মন্দিরে নিত্য পূজা সহ বিশেষ বিশেষ দিনে তিনি ধুমধাম করে নানান ধরনের অনুষ্ঠান করতেন। অতঃপর ১২২৬ সালে বাংলার সুবেদার গিয়াসউদ্দিন বলবন অতর্কিত ভাবে বীরসিংহপুর আক্রমণ করেন এবং সেই যুদ্ধে বীর সিংহ পরাজিত হোন এবং নিহতও হোন। পরের বছর গিয়াসউদ্দিনের মৃত্যু হলে বীর রাজার বংশধরেরা বীরসিংহপুর থেকে চলে গিয়ে রাজনগরে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। সঙ্গে নিয়ে যান কূলদেবী কালীকে। রাজার উদ্যোগে রাজনগরের কালীদহ পুকুরের উত্তর দিকে দক্ষিণমুখী বিশালাকার মন্দিরে ওই কূলদেবী কালীকে প্রতিষ্ঠা করা হয়। অতঃপর ১৬০০ সালে ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ থেকে আগত দুই পাঠান বীরের অতর্কিত আক্রমণে বীর রাজাদের পতন ঘটে। কথিত রয়েছে যে, কালীদহের পুকুরের জল অপবিত্র হলে মা আর রাজনগরে থাকতে চান না। সেই কারণেই কুশকরণীর নদীর জলে ভাসতে ভাসতে খটঙ্গা গ্রামে কাছে আটকে যান। পরের দিন সকালে জেলেরা মাছ ধরতে গিয়ে এই কালী মূর্তিটি পায়। জেলেসহ ভক্তরা ওই মূর্তিটি বীরসিংহপুরে বীর রাজার কালী মন্দিরে ঘটা করে প্রতিষ্ঠা করে। পরে রাজনগরের রাজা আসাদুজ্জামানের দেওয়ান রামনাথ ভাদুড়ী এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন এবং সেবা পুজার ব্যবস্থা করেন। যেহেতু মগধ থেকে মাকে আনা হয়েছিল বলেই এখানকার মাকে মগধেশ্বরী কালী নামে পরিচিতা। সেই অনাদি কাল থেকেই মহা ধুমধামে কষ্টি পাথরের মূর্তি মা কালী সারা বছর ধরে পূজা হয়ে আসছে।
দীপান্বিতা অমাবস্যার রাতে কালী পুজোয় প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়। মন্দিরটি আলোক মালায় সাজানো হয়েছে। পুজো কমিটির সদস্য মায়ের ভক্ত সন্দীপ ভান্ডারী জানান যে, এই কালী মাতারা ছিলেন সাত বোন। এর মধ্যে মগধেশ্বরী কালী ছিলেন মেজ বোন। পাঠানদের অত্যাচারে রাজনগর থেকে চলে এসে এখানে পুজিতা হোন মা। বহু বছর আগে মন্দিরের আশপাশে তাঁতিদের বসবাস ছিল। সারারাত তাঁতিরা তাঁত চালিয়ে কাপড় বুনতেন। তাঁত বোনার খটখট আওয়াজে মা খুব অসন্তুষ্ট হোন। মা স্বপ্নাদেশ দেন যে, তাঁতিদের এলাকা ছেড়ে চলে যেতে। এরপর অনেক তাঁতি স্বপ্নাদেশ পেয়ে বীরসিংহপুর ছেড়ে চলে যায়। এমন নানান লোককথা স্থানীয় মানুষের মনে প্রচলিত রয়েছে। এখনও এই মন্দিরে মায়ের নিত্য সেবা পুজা হয়। মা খুব জাগ্রত দেবী। মনোস্কামনা পূরণের জন্য মায়ের কাছে বহু ভক্ত নরনারী ধর্না দেন। শারদীয়া দুর্গাপূজার পর কালী পুজো হয় মহা ধুমধামে। জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু পুণ্যার্থীরা এই কালী মন্দিরে সামিল হোন।