উত্তম মণ্ডলঃ
আসলে মিষ্টি রসে ডোবানো সংরক্ষিত ফল। নাম তার—মোরব্বা। বহুদিন থেকেই মোরব্বা একটি কুলীন মিষ্টদ্রব্য। তবে এর মধ্যে ছানা নেই, দুধ নেই। আছে প্রকৃতিজাত কিছু ফলমূল। শক্তিগড়ের ল্যাংচা, বর্ধমানের সীতাভোগ, কৃষ্ণনগরের সরভাজা, জয়নগরের মোয়া, তেমনি বিখ্যাত বীরভূম জেলার সদর শহর সিউড়ির মোরব্বা। একসময় মহানায়ক উত্তম কুমারের জন্যও মোরব্বা গেছে এই সিউড়ি থেকে। আজও বহু মোরব্বাপ্রেমী মানুষ আসেন মোরব্বার খোঁজে।
বাংলায় “মুরুব্বি” বলে একটি কথা প্রচলিত আছে, যার প্রবীণ ব্যক্তি, অর্থাৎ পাকা মানুষ। পাকা মানুষের গুরুত্ব আছে। বলা হয়, পাকা মাথার বুদ্ধি বেশি। তাই পাকার গুরুত্ব রয়েছে। আর এই পাকা একটি বস্তু হলো “মোরব্বা।” মুরুব্বির মতোই পাকা এই মোরব্বা।
দক্ষিণ ককেশাস, পশ্চিম এশিয়া, মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়ার একটি জনপ্রিয় মিষ্টি। পাশাপাশি এটি ওষুধ ও পথ্য হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
যেমন,—
বেলের মোরব্বা : কোষ্ঠকাঠিন্য রোগে,
আমলকির মোরব্বা : মুখের রুচি ফেরাতে,
হরিতকি : হজমে ব্যবহৃত হয়।
খেজুরের মোরব্বা তো আমরা অহরহ খেয়ে থাকি। পিণ্ড আকারে পিণ্ডরূপী খেজুরের মোরব্বা দেবতার ভোগেও লাগে।
ফল সংরক্ষণের পথেই মোরব্বার জন্ম। ফল, চিনি, মশলা মিলেই মোরব্বা।
বীরভূমের মোরব্বার জন্ম রাজনগরে। জেলা বীরভূমের একদা রাজধানী রাজধানী বর্তমানে ঝাড়খণ্ড লাগোয়া প্রান্তিক অঞ্চল এই রাজনগর।
রাজনগরের পূর্বনাম ছিল “লক্ষ্মণনগর”। রাজা লক্ষ্মণসেনের নাম অনুসারেই এই নাম। রাজনগরের গাংমুড়ি-জয়পুর গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত পাটমুড়ির অদূরে রয়েছে “লক্ষ্মণপুরের ডাঙা”। এখানে ছিল সেনরাজ লক্ষ্মণসেনের কাছারি বাড়ি। উঁচু ঢিবির মধ্যে রয়েছে পুরোনো ধ্বংসাবশেষের চিহ্ন। এখানে-ওখানে পড়ে কিছু পুরোনো ইঁটের টুকরো। উঁচু ঢিপি। বছর কয়েক আগে এখান থেকে মাটির তৈরি পুরোনো জল-পাইপ উদ্ধার হয়। কুশকর্ণী ও খেজুরঝুড়ি দুটি নদীর বাঁকেই অবস্থিত এই প্রত্নক্ষেত্র। বর্তমানে এটি ব্যক্তিগত মালিকানাধীন। প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ হলে এখান থেকে আঞ্চলিক ইতিহাসের অনেক কিছুই বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা।
খ্রিস্টিয় চতুর্দশ শতাব্দীতে রাজনগরে শাসকপদে পালা বদল ঘটে। বীরত্বের জন্য জনসাধারণের কাছে খ্যাতকৃত্য রাজনগরের হিন্দু “বীররাজা” বসন্ত চৌধুরী অতর্কিত আক্রমণে নিহত হোন নিজের দুই পাঠান সেনাপতি ভাই আসাদ খান ও জোনেদ খানের হাতে। বীররাজা বসন্ত চৌধুরীর সঙ্গে লড়াই করতে করতে দু’জনেই পড়ে যান একটি কুয়োতে। দু’জনেরই মৃত্যু হয়। শুরু হয় জোনেদ খানের হাত ধরে বীরভূমে পাঠান রাজত্ব।
বীরভূম তখন ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ। আজকের ঝাড়খণ্ড তখন ছিল বীরভূমের অংশ। বর্তমান ঝাড়খণ্ডের বৈদ্যনাথ-দেওঘর পর্যন্ত ছিল বীরভূমের মধ্যে। আর বীরভূমের রাজধানী তখন রাজনগর। চারদিকে বেল, হরিতকি, কুল, শতমূলী, আমলকিসহ বিভিন্ন গাছ তখন বনে। এছাড়া রাজনগরের পাঠান রাজারাও বহু ফলের গাছ লাগিয়েছিলেন। এই রাজনগরের পাঠান রাজাদের কেউ একজন উত্তর ভারত বেড়াতে গিয়ে সেখানে চালকুমড়োর মোরব্বা খেয়ে ভীষণ খুশি হোন। তারপর বীরভূমের রাজধানী রাজনগরে ফিরে এসে মোরব্বা তৈরির উদ্যোগ নেন। এজন্য মোদক সম্প্রদায়ের লোকজনকে এনে রাজনগরে বসানো হয়। শুরু হয় রাজনগরের মোরব্বা।
এরপর রাজনগর থেকে কিছু কারিগর কর্মসূত্রে সিউড়ি চলে যান। সিউড়ীতেও তাদের হাতে তৈরি হলো মোরব্বা। তবে সিউড়ির পাশাপাশি বীরভূমের মোরব্বার উৎসস্থল জেলার প্রান্তিক অঞ্চল রাজনগরেও দেদার বিকোয় বিভিন্ন ফলের মোরব্বা। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে, রাজনগর থেকে মোরব্বা গেল সিউড়ি এবং সিউড়ি থেকেই মোরব্বা হলো বীরভূম বিখ্যাত।
রাজনগর ও সিউড়ির আবহাওয়া মোরব্বার অনুকূল। তাই এই দুই জায়গার মোরব্বার স্বাদই আলাদা।
সিউড়ির বাসস্ট্যাণ্ড সংলগ্ন “মোরব্বা” নামের দোকানটি দীর্ঘদিন ধরে মিষ্টি রসিকদের মোরব্বা জুগিয়েছে। এখানে পাশাপাশি আরও কয়েকটি দোকান রয়েছে, সেখানেও অন্যান্য মিষ্টির পাশাপাশি থরে থরে সাজানো বেল, হরিতকি, শতমূলী ( এটি একটি কাঁটাজাতীয় ছোট বন্য গাছের মূল বা শিকড়) , আমলকির মোরব্বা। জানা যায়, এসব দোকানের কারিগর আসে বেনারস থেকে। তবে হরিতকির মোরব্বা আলকাতরার মতো কালো বলে বর্তমানে তার চাহিদা কমে গেছে। সবাই এখন চকচকে জিনিস চায়। তাই প্রথম পেটের পক্ষে উপকারী হলেও শুধুমাত্র কালো রঙের কারণেই তার চাহিদা নিম্নমুখী হয়েছে। তবে চালকুমড়ো, পটল, আমলকি, শতমূলীসহ অন্যান্য বিভিন্ন ফলের মোরব্বার চাহিদা যথেষ্ট। ফল সংরক্ষণ থেকে ওষুধ, পথ্য—সবকিছুই রয়েছে এই মোরব্বার মুরুব্বিয়ানায়।
তথ্যসূত্র :
১) বীরভূমের ইতিহাস : গৌরীহর মিত্র।
২) ব্যক্তিগত ক্ষেত্র সমীক্ষা।