উত্তম মণ্ডলঃ
প্রথমে “লাভ” এবং তারপর “ম্যারেজ” নিয়ে বহুক্ষেত্রেই ছাদনাতলা ছাড়াই কনেকে ঘরে গ্যারেজ করে এখন হচ্ছে “লাভ গ্যারেজ।” ফলে ছাদনাতলায় একসময়ের নাপিতের মুখে বিয়ের ছড়া আজ হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ বর ও কনে— দু’ পক্ষের ছড়ার তরজা শুনতে রাতভর মানুষ বিয়ের ছাদনাতলায় ভিড় জমাতো। সেসব এখন বঙ্গ সংস্কৃতিতে ব্যাক ডেটেড্।
নাপিতের মুখের এইসব ছড়া ছিল দু’ রকমের, এক, রাম-সীতা বিষয়ক এবং দুই, শিব-পার্বতী বিষয়ক। এই দুই দম্পতিকেই বাঙালি চিরকাল আদর্শ বলে মেনে এসেছে। তাই ছড়ার বিষয়েও রাম-সীতা এবং শিব-পার্বতী অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হিসেবে থেকেছেন বাঙালির বিয়ের ছাদনাতলায়। আর এইসব ছড়াগুলি হচ্ছে প্রধানত গার্হস্থ্য বিষয়ক, প্রেম বিষয়ক নয়।
মৌর্য সম্রাট অশোকের অনুশাসনে মেয়েলি শুভ অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে “মঙ্গল” শব্দের উল্লেখ দেখা যায়। “মঙ্গল” শব্দের বৈদিক অর্থ হচ্ছে, নববধূ ও বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পর্কে মঙ্গলগীত।” যে সব মেয়েরা বিয়ের গান করতেন, প্রাকৃত সাহিত্যে তাঁদের বলা হতো “মঙ্গলগায়িকা।”
ঋগ্বেদের ১৪২ সূক্তে নাপিতের উল্লেখ দেখা যায়।
কন্যার আরেক নাম “দুহিতা”। গো-দহন করার জন্য কন্যাকে বলা হতো “দুহিতা”।
এখানে বাঙালি বিয়েতে নাপিতের মুখে প্রচলিত কিছু ছড়ার নমুনা দেওয়া হচ্ছে:
১) হরগৌরী বিবাহের কথা শুনুন শুনুন মহাশয়, করি নিবেদন।
হরগৌরীর বিবাহ কথা, করি গো বর্ণন।।
হরগৌরীর বিবাহে কৌতুক লাগিল।
বরণডালা লয়ে রাণী মেনকা আইল।।
কুমকুম কস্তুরি আমলা মেথি যত।
সকল দ্রব্য লয়ে থালা করিল পূর্ণত।।
সাততী ঘুরাইতো যখন দেউটি জ্বালিয়া।
শিবের নিকটে যান স্বর্ণথালা লইয়া।।
তাহার মধ্যে ছিল এক ঈশ্বরমূলের মূলী
ঈশ্বরমূলের গন্ধ পাইয়া পালায় ভূজঙ্গ।
তাহা দেখি সদানন্দ হইলেন উলঙ্গ।।
লজ্জিত হৈয়া রাণী যান অন্তপুরে।
ছি: ছি: বলিয়া নিন্দা করেন শংকরে।।
ভবেতে ভবানী পদ হরষিত মনে।
অসংখ্য প্রণাম আমার ব্রাহ্মণের চরণে।।
সভাসদগণে আমি নমস্কার করি।
জাতিতে নরসুন্দর শ্রীপাণ্ডব ভাণ্ডারী।।( লেখকের সংগৃহীত)
২) যত সব সখীগণে আনন্দিত মনে
সবে ঘোমটা টানি সভাতে বসিয়ে,
বেদধ্বনি মতে দিচ্ছে উলুধ্বনি
শিবদুর্গার বিবাহ হয় স্বর্ণমুকুট মাথে।
আনন্দিত হয়ে গিরি বলেন শিবের হাতে
কৌতুক করেন গিরি করেন সম্মানেতে।
এ কারণে নরসুন্দর করেন গোমোক্ষণ
উত্তর দিকে কৃষ্ণবর্ণ গাভী ছিল
গাভীর বন্ধন মুক্ত হৈল।
এখানে উল্লেখ্য, কন্যার বিয়েতে গাভী দান করা হতো। কালো রংয়ের গাভীর দুধ মিষ্টি হয়, এরকম একটি কথা প্রচলিত আছে গ্রামবাংলায়। তাই কৃষ্ণবর্ণের গাভী দানের প্রাধান্য ছিল বেশি।
৩) নম: নম: গণপতি প্রণাম চরণে
গোমোক্ষণ করি আমি শুনুন সর্বজনে।
কর্ণেতে ধুতুরা ফুল বৃষোপরি চড়ি
ঢলিতে ঢলিতে যায় গিরি রাজার বাড়ি
কদলীর বৃক্ষ দিয়ে মুক্ত আচ্ছাদিয়ে
লগ্ন অনুসারে শিবানী উত্তরিল গিয়ে।
লয়ে পুষ্পমালা নাপিতের নন্দন
শিবের নিকট আসিয়া দিল দরশন।
মনোহর পাত্র ভোলা, ছোড়লা করেছে আলা
মস্তকেতে শোভা করে কান,
উলুধ্বনি মংলা ( মঙ্গলধ্বনি) গায় যতেক রমণী,
ছোড়লা তলায় দাঁড়িয়ে নাপিত বলে, হরি হরি।
দেবকান্ত, দেরুকান্ত সভাবন্দ নর
এই গোমোক্ষণের দক্ষিণা দিয়া কন্যা নিয়ে যান ঘর।
৪) শ্রীরামের বিবাহ শুনিয়াছেন সকল
মুনি দণ্ড কমণ্ডুলু করি হাতে
স্বর্গে নাচে দেবগণ, মর্ত্যে নাচে সর্বজন
হরিষে নারীগণ
শ্রীদেব সঙ্গে নাচিছেন ব্রহ্মা রঙ্গে।
শচী সঙ্গে নাচেন শচীপতি স্থাবর জঙ্গম আদি
সবে নাচে চমকারী, উল্লসিত নাচে
বসুমতি দিব্য দিব্য আভরণ সাজায় কত রাঙা পায়
শ্রীরাম নিরখিতে সম্মুখে নাচেন বিদ্যাধরী
রত্নের প্রদীপ জ্বালেন পরিপূর্ণ সারি সারি।
৫) শুনুন শুনুন মহাশয় করি নিবেদন
জানকী রামের বিবাহ কথা করুন শ্রবণ।
কন্যাদান মহাদান সর্বশাস্ত্রে কহে
তার সম ফল আর এ সংসারে নহে।
অবনীতে যদি কন্যাদান কেহ করে
ত্রিভুবন আনন্দিত প্রফুল্ল অন্তরে।
শুনেছিলাম শ্রীরামের বিবাহের কালে
হরের ধনুক ভেঙেছিল রাজার নন্দন।
শ্রীরামের আজ্ঞা পেয়ে গেলেন অন্ত: পুরে
রাজনন্দন আইল রাজকন্যা প্রফুল্ল অন্তরে।
গাল বাজাইয়া নৃত্য করে ত্রিলোচন
শ্রীরামের বিবাহ হয়েছিল, বদন ভরিয়া হরি হরি বল।
এছাড়াও বাংলার মাল ও বাউরী সম্প্রদায়ের মানুষের বিয়ের গান আছে। এইসব গানের মধ্যেও সেকালের সমাজ জীবনের ছবি ফুটে ওঠে। যেমন, নিচের মালদের বিয়ের গানটিতে খৈ-মুড়ি ভাজার খোলার উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে, যেমন:
একখানা উত্তরের খোলা
একখানা দক্ষিণের খোলা।
সেই খোলাতে ভাজা ভাজো রে বাছা,
হোক্ ক্যানে বেলা।
নতুন করে খোলা চাউল রে ভাজলাম
ভাজলাম কুনের গুঁড়ো
এই গুঁড়ো যে না খাবে
হে বাছা, তাকে মারব রে হুড়ো।
বাউরীদের বিয়ের গান:
ছিঁটা কাপড় লিলেক না জামাই, লিলেক না
ছিঁটা কাপড়, লিলেক না।
কুথা যাবি, আমডুবি?
মাগীর লেগে আনবি গাবগুবি।
এক সময়ের সমাজ দর্পণ এইসব ছড়াগুলি আজ প্রায় হারিয়েই যাচ্ছে। লোকসংস্কৃতির এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সংরক্ষণের আশু প্রয়োজন।