এলাকার শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষজনের দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে: দিগুলী সাঁওতাল কাটার পুকুরকে জাতীয় পর্যটনস্থল স্বীকৃতি দিলো ঝাড়খন্ড সরকার

সনাতন সৌঃ

বীরভূম জেলার সদর শহর সিউড়ী থেকে প্রায় বারো কিলোমিটার দূরে-বীরভূম-ঝাড়খন্ড সীমান্ত লাগোয়া কেন্দুলী গ্রামে নাকা চেকিং পার হলেই রাস্তার ধারেই দেখা যাবে দিগুলী গ্রামে ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহের পটভূমি স্মৃতি বিজড়িত সাঁওতাল কাটার পুকুরটি। দীর্ঘদিন যাবৎ এলাকার শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষজনের দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে ঝাড়খন্ড রাজ্য সরকার ঐতিহাসিক এই পুকুরটিকে জাতীয় পর্যটনস্থল স্বীকৃতি দিলো। এই সংবাদটি প্রচারিত হওয়ার পরই এলাকায় জনমানসে দারুন সাড়া পড়েছে। এলাকাবাসী রাজ্য সরকারের কর্তৃপক্ষকে ও আন্দোলরত উৎসাহী মহান ব্যক্তিদের সাধুবাদ জানিয়েছেন। প্রসঙ্গত বলা যায় যে, একটা সময় সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতার জাঁতাকলে সাঁওতাল সমাজ হয়ে গিয়েছিল সর্বহারা রিক্ত নিঃস্ব। সেই সময় সাঁওতাল অধ্যুষিত এলাকাটি ছিল বীরভূমের পশ্চিমাঞ্চল ও সাঁওতাল পরগনার পাহাড় জঙ্গল মহলে। তাদের এবড়োখেবড়ো পাথুরে জমিগুলো তদানীন্তন ইংরেজ সরকার জোর করে চাষের জন্য কিংবা রেল লাইন তৈরি করার জন্য ব্যবহার করে এবং বেশ কিছু জঙ্গলও উচ্ছেদ করে দেয়। এই সব আবাদী বা অনাবাদি জমির রাজস্ব কর বুভুক্ষু সাঁওতাল চাষীর কাছ থেকে জোরপূর্বক আদায় করতো ইংরেজ মদতপুষ্ট মহাজন জমিদাররা। জমির খাজনা অপ্রত্যাশিত বৃদ্ধির জন্যই মহাজনী শোষণও বেড়ে যায়। এই অত্যধিক জমির রাজস্ব কর সময়মতো দিতে না পারায় অত্যাচারে শিকার হয়েছিল সাঁওতাল সমাজ। নারীদেরও উপর অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছিল। দুশমন ইংরেজদের অত্যাচার অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে সাঁওতাল সমাজ একত্রিত হয় ভগনাডিহি গ্রামে। এই বিরাট সমাবেশে আদিবাসী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন অন্যতম নেতা সিধু ও কাণু। এই সাঁওতাল সমাবেশে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, সাঁওতাল আদিবাসীদের দুশমন ইংরেজ ও মহাজন শোষক জমিদারদের উৎখাত করতে হবে। সহ্য করা হবে না তাদের নির্দেশ, কালা আইন ও অত্যচার। সাঁওতালরা কায়েম করবে তাদের শাসন ও আইন। সাঁওতালদের নেতা ও রাজা হবেন সিধু ও কাণু। তাদের কথাই হবে শেষ কথা। সে সময় ভারতের রাজধানী ছিল কলকাতা। বড়লাট সাহেব ছিলেন প্রশাসনিক অধিকর্তা। সাঁওতাল অধ্যুষিত এলাকায় মহাজনী শোষণ ও অকথ্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে নালিশ জানানো হবে বড় লাট সাহেবের কাছে। ভগনাডিহি গ্রাম থেকে আন্দোলনকারী সাঁওতালরা প্রথাগত অস্ত্র সস্ত্র হাতিহার নিয়ে পায়ে হেঁটে বড় লাট সাহেবের কাছে নালিশ জানানোর জন্য কলকাতা রওনা হোন। সেই সময় আন্দোলনকারীরা জানতেন না কলকাতা কতদূর পথ, সেখানে যেতে কত সময় লাগবে। চলার পথে রাণীশ্বরের ময়ূরাক্ষী নদী পার হবার সময় ইংরেজ সৈনিকরা সাঁওতাল আন্দোলনকারীদের উপর অতর্কিত আক্রমণ করে। ১৮৫৫ সালে সাঁওতাল বিদ্রোহের সময় ইংরেজদের সঙ্গে সাঁওতালদের চরম লড়াই হয়েছিল আমজোড়া গ্রামের কাছেই দিগুলী-কেন্দুলী গ্রামের মধ্যস্থলে। ঘটতে থাকলো আক্রমণের পর আক্রমণ। এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় বিদ্রোহীরা ছড়িয়ে পড়লো। এগিয়ে গেল সিউড়ী শহরের দিকে। সেসময় দিগুলী গ্রামের কাছেই লাঙ্গুলিয়া থানা ছিল। সে সময় দিগুলী গ্রাম সহ বেশ কয়েকটি অঞ্চল লাঙ্গুলিয়া থানার অন্তর্ভুক্ত ছিল। সাঁওতাল আন্দোলনকারীরা লাঙ্গুলিয়া থানা ঘেরাও করে। বিদ্রোহীদের রোষানলে লাঙ্গুলিয়া থানা এলাকায় তিনশোর বেশি ঘর আগুনে পুড়ে যায়। এখন অবশ্য লাঙ্গুলিয়া থানার অস্তিত্ব নেই। তবে এখনও পর্যন্ত থানা পুকুর, কাছারী মাঠ ও নীলকুঠি নামে পরিচিত আছে। তদানীন্তন কালে পুরাতন সার্ভে রেকর্ডেও লাঙ্গুলিয়া থানার নাম উল্লেখ আছে। পরে সীমানা নির্ধারণ করার সময় বীরভূমের দিগুলী গ্রাম সহ বেশ কয়েকটি অঞ্চল সাঁওতাল পরগণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। লাঙ্গুলিয়া থানা উঠে যায় এবং লাঙ্গুলিয়া গ্রাম সিউড়ী থানায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ইংরেজদের সাড়াশি আক্রমণে আর এগোতে পারে নি। সেদিনের ইংরেজদের আধুনিক অস্ত্রে হার মেনেছিল সাঁওতালদের প্রাচীন অস্ত্র। ইংরেজরা আন্দোলনরত সাঁওতালদের উপর নির্মমভাবে অত্যাচার করেছিল এবং নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল। এই ভয়ানক গুলিতে দশ হাজারের অধিক আন্দোলনকারী সাঁওতালদের মৃত্যু হয়েছিল। তাদের রক্তে এলাকাজুড়ে লাল হয়ে যায়। তাদের মৃতদেহের লাশগুলো সাঁওতাল কাটার পুকুরে এবং ময়ূরাক্ষী নদীর জলে ফেলে দেওয়া হয়। সাঁওতাল বিদ্রোহী আন্দোলনের দুই বীর যোদ্ধানেতা সিধু ও কাণুকে বন্দী করা হয় এবং পরে অমানবিকভাবে গাছে ফাঁসি দেওয়া হয়। এই ভয়ানক দৃশ্য বিষয়ে এলাকার আমজোড়া গ্রামের বিশিষ্ট সাহিত্যপ্রেমী ও চিকিৎসক হারাধন চট্টোপাধ্যায় একটি কবিতায় উল্লেখ করেছেন—- দুষ্ট ইংরেজ সৈনিকরা আন্দোলনকারীদের উপর/ এদিক-ওদিক মারলো গুলি/ তার নাম হলো দিগুলী।—- পরে ১৯৩২ সালে তদানীন্তন ইংরেজ সরকার সার্ভে রেকর্ডে এই স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক পুকুরটিকে সাঁওতাল কাটার পুকুর হিসেবে চিহ্নিত করে এবং এলাকার মানুষের কাছে সাঁওতাল কাটা পুকুর নামে পরিচিত লাভ করে।
দীর্ঘদিন যাবৎ এই ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত সাঁওতাল কাটার পুকুরটি অবহেলায় অনাদারে পড়ে ছিল। এলাকার মানুষজন এই ঐতিহাসিক পুকুরটিকে মর্যদার দাবিতে আন্দোলনের পথে নেমেছিলেন। ইতিপূর্বে এই পুকুটি দ্রুত মর্যদা পায় তার জন্য রাণীশ্বর গ্রামে প্রদীপ সাধুর বাস ভবনে এলাকার শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই বৈঠকে নেতৃত্ব দেন ঝাড়খন্ড বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষা সমিতির রাজ্য সভাপতি তথা বরিষ্ঠ সাংবাদিক গৌতম চট্টোপাধ্যায়। ওই কমিটিতে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রতিনিধি হিসেবে আমাকেও কার্যকরী সদস্য মনোনীত করা হয়। আমিও এ কাজে সামিল হই। অতি সত্বর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়, সে বিষয়ে প্রশাসনের কাছে জোরালো দাবি জানানো হয়। তার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের পদস্থ কর্মকর্তারা সাঁওতাল কাটার পুকুরটি পরিদর্শন করেন। পরে ওই পুকরটি পাঁচিল দিয়ে ঘেরাও করা হয়েছে। তাতেও ক্ষান্ত হয়নি এলাকার মানুষজন। গৌতম চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের নেতৃত্বে এই পুকুরটিকে জাতীয় মর্যাদার দাবীতে আবারও লাগাতার আন্দোলন করেন এবং প্রশাসনের কাছে এক প্রস্তর দাবীপত্র পেশ করেন। যার ফলে সরকারের টনক নড়ে। অবশেষে সরকার কর্তৃপক্ষ তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তার ফলস্বরূপ এই ঐতিহাসিক পুকুরটিকে জাতীয় পর্যটনস্থল হিসেবে মান্যতা দিলো। বিশেষ করে গৌতম বাবুর প্রচেষ্টায় এবং ডেপুটি কমিশনার রবি শঙ্কর শুক্লার অনুপ্রেরণায় ইতিহাসকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়ার পরিনামে সাঁওতাল কাটার পুকুরটি জাতীয় স্মৃতিসৌধ হিসেবে উন্নীত হয়েছে বলে জানা যায়। মশানজোড় ড্যাম আসার পথে বিভিন্ন রাজ্য থেকে পর্যটকরা এই ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত পুকরটি পরিদর্শন করে যাচ্ছেন। এছাড়াও সাঁওতাল কাটার পুকুরের প্রতি দৃষ্টি দেওয়ার বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে ছিলেন এলাকার বিশিষ্ট সাহিত্যিক, লেখক ও প্রধান শিক্ষক প্রয়াত শ্রীদাম বন্দ্যোপাধ্যায় সহ বেশ কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।
প্রসঙ্গত আরও উল্লেখ করা যায়, আমরা বীরভূমের সর্বাধিক প্রচারিত সাপ্তাহিক নয়াপ্রজন্ম পত্রিকায় ঐতিহাসিক সাঁওতাল কাটার পুকুরটিকে মর্যাদার দাবীর বিষয়ে বেশ কয়েকটি কিস্তিতে লেখালেখি করেছি। এই প্রসঙ্গে পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক প্রয়াত কাঞ্চন সরকার আমাকে ও আমার আর এক সহযোদ্ধা তীর্থকুমার পৈতন্ডীকে সৎ সাহস দিয়েছিলেন। তিনিও আমাদের সাথে এই ঐতিহাসিক পুকুরটি পরিদর্শন করেছিলেন। বিশেষ করে যখন এই ঐতিহাসিক সাঁওতাল কাটার পুকুর পাড় ঘিরে চোলাই মদের ঠেক হিসেবে দখল করেছিল। চোলাই মদের ঠেক প্রসঙ্গে ২০০৯ সালে ৭ জানুয়ারী নয়াপ্রজন্ম পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল তীর্থকুমার পৈতন্ডীর একটি প্রতিবেদন “মদের কালো ধোঁয়ায় ধুকছে ঐতিহাসিক সাঁওতাল কাটার পুকুর”। এই প্রতিবেদনটি প্রচারিত হওয়ার পরই এলাকায় জনমানসে দারুন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং পুলিশ প্রশাসনের টনক নড়ে। তার পরিপ্রেক্ষিতে সিউড়ী থানার পুলিশ অধিকর্তা “তেড়ে নাম” ওরফে লক্ষ্মীনারায়ণ দে মহাশয় অভিযান চালিয়ে সাঁওতাল কাটার পুকুর পাড়ের চোলাই মদের ঠেকটি উচ্ছেদ করেছিলেন। এবিষয়ে বীরভূম জেলার বিশিষ্ট সাংবাদিক প্রয়াত কাঞ্চন সরকারও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নয়াপ্রজন্ম পত্রিকার মাধ্যমে প্রশাসনের কাছে জোরালো দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *