সনাতন সৌঃ
১৫ জানুয়ারী ২০২৪, পাইকরে বহু প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন এবং সম্ভবত সেন, পাল ও চেদীরাজ যুগের ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শন গুলি শিবজ্ঞানে পূজিত হয়ে আসছে। সেই মন্দির পাইকর তথা এতদ অঞ্চলে বুড়ো শিব মন্দির নামে সুপরিচিত। একদা অত্র গ্রামের তৎকালীন পাণ্ডা পরিবারের কোন এক মহামানব ঐতিহাসিক নিদর্শন গুলোকে একটি মাটির তৈরি ছোট মন্দিরে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন, সেই সময় থেকেই এখানে রক্ষিত ৭০/৭২ টি প্রাচীন শিল্প গুণ সমৃদ্ধ মুর্তি গুলোকে পাণ্ডাবাড়ির দেব ভক্তি সম্পন্ন মানুষ বংশ পরম্পরায় শিবজ্ঞানে পুজো পার্বণ করে আসছিলেন। ক্রমশই এই দেববিগ্রহগুলোকে সেবকরা ও গ্রামের মানুষ বুড়ো শিব নামে অভিহিত করতে থাকেন এবং তখন থেকেই এ মন্দির প্রাচীন বলে বুড়ো শিব মন্দির নামে সর্বজনীন পরিচিতি লাভ করে। জনশ্রুতি আছে এই পাণ্ডা পরিবারের জমিদারি বন্দোবস্ত চালু ছিল। কথিত আছে তৎকালীন সময়ে বিহারের সিংভূম জেলার এক শিবভক্ত প্রসেন সিংহের ছেলে মারাত্মকভাবে বসন্তরোগে আক্রান্ত হয়ে পরলে এই দেব স্থানে এসে আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় অত্যন্ত পারদর্শী তৎবংশিয় হৃষিকেশ পাণ্ডা মহাশয়ের সুচিকিৎসায় এবং এই বুড়ো শিব এর স্নান জল পান করে মারাত্বক মারণ অসুখ থেকে মুক্ত হয়। তাদের স্থির বিশ্বাস জন্মায় দেব মাহাত্ম্য ছাড়া এই মরণরোগ থেকে মুক্ত হওয়া অসম্ভব ছিল। তখন সেই সিংহ মহাশয় পুত্রের প্রাণ ফিরে পেয়ে অত্যন্ত খুশি হয়ে কৃতজ্ঞ চিত্তে হৃষিকেশ পাণ্ডা মহাশয়কে কিছু দানদক্ষিণা দিতে অতি ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। তখন কবিরাজ পাণ্ডা মহাশয় তাঁকে বলেন – ঐতিহ্যবাহী শিব বর্ষাকালে জলে ভাসে আর গ্রীষ্মকালীন সময়ে রৌদ্রে পোড়ে। নিতান্তই কিছু দান করতে চাইলে সম্মুখের এই ভগ্নপ্রায় বুড়ো শিবের মাটির মন্দিরটি ইটের পাকা মন্দির করে দেওয়ার কথা বলেন। সেই সময় ১৯০৯ সালে শ্রী সিংহ মহাশয় পাকা মন্দিরটি নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। সেও প্রায় দুই শতাধিক বছর আগের কথা।
বর্তমানে সে মন্দিরও ভগ্ন অবস্থায় এসে পৌঁছেছিল। জমিদার পাণ্ডা বাড়িও কালের গতিতে দুর্বল হয়েছে। মন্দিরটি পুনরায় নির্মাণের জন্য সরকারি বেসরকারি ভাবে বহু চেষ্টা করে। সে পাণ্ডা পরিবার বর্তমানে চ্যাটার্জীতে রূপান্তরিত হয়েছে। এই পরিবারের কিছু কর্তাব্যক্তি মন্দিরটি পুনঃনির্মাণ কল্পে কিছু নির্বাচিত গ্রামবাসীকে আলোচনার জন্য আহ্বান করেন এবং সেখানে তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব রাখা হয় ভগ্নপ্রায় বিপদজ্জনক এই মন্দির ভেঙ্গে পুনর্নির্মাণ অত্যন্ত জরুরি, কিন্তু আমরা প্রায় সকলেই আর্থিকভাবে দুর্বল। আমাদের পরিবারের সকলের মিলিতভাবেও মন্দির নির্মাণের জন্য ১২ /১৪ লক্ষ টাকা ব্যয় করা কখনও সম্ভব হবে না। আমরা আমাদের পরিবার সম্মিলিত ভাবে বড়জোর তিন থেকে চার লাখ টাকা ব্যয় করতে সক্ষম হতে পারি। বাকি অর্থসংগ্রহের বিষয়ে আপনাদের আন্তরিকভাবে সহযোগিতার প্রয়োজন। তখন গ্রামবাসী এবং চ্যাটার্জী পরিবারের অনেকেই বলেন – এই পরিবারের সুসন্তান অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কান্তিভূষণ চ্যাটার্জী সামনের সারিতে থাকলে সম্ভবত অর্থসংগ্রহে কোন অসুবিধা হবে না। সেসময় চ্যাটার্জী পরিবারের সাথে গ্রামবাসীও সহমত হন। কান্তিভূষণ যার গ্রাম্য নাম নাদু এবং বছর তিন/চার আগে করোনাকালীন সময়ে তাঁর স্ত্রী বিয়োগ ঘটেছে, নিজে শারীরিক ভাবে বেশ অসুস্থতার কারণে তার ছোট মেয়ের বাড়ি বর্ধমানে অবস্থান করেন। এই অবস্থায় তিনি সম্মতি জানায় এবং অসুস্থ শরীরে বর্ধমান-পাইকর যাতায়াত করে পরিবার ও গ্রামের উৎসাহী কয়েকজন যুবকদের সঙ্গে নিয়ে সম্প্রতি মন্দির নির্মাণ কাজটি সমাধা করতে সক্ষম হয়েছেন। অবশ্যই এখানে গ্রামস্থ প্রবীন মানুষ প্রনব গাঙ্গুলী বিশেষ ভাবে উৎসাহিত করেন। চ্যাটার্জী পরিবারের সুকান্ত, রাজিবের নাম উল্লেখযোগ্য এবং প্রতিবেশিদের মধ্যে গৌর রজক, গৌতম দত্তের নাম ও বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। চ্যাটার্জী পরিবারের কান্তি ভূষণ, সঞ্জয় ও সুভাষ মিলিতভাবে তিন লাখ টাকা এবং অন্য তরফ দেবব্রত ও শোভন চ্যাটার্জী এক লাখ টাকা দিয়ে কাজ শুরু করেন এবং বাকী প্রায় আট / নয় লক্ষ টাকা কঠোর পরিশ্রমে গ্রামবাসী, পাইকর ও মুরারই থানার অধীনস্থ গ্রামের মানুষজন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় মন্দির অভিষেকের কাজ সম্পন্ন হয়েছে গত ৮ জানুয়ারি ২০২৪। সেখানে কান্ধি দোহালিয়া কালীবাড়ির সেবক ত্যাগী মহারাজ আর গ্রামের মা ক্ষ্যাপা কালীর পুরোহিত নারায়ণ ব্যানার্জী সঙ্গে সহযোগিতা করেন। সেদিন গ্রামের অধিকাংশ গৃহবধূরা কাকভোরে ২০/২৪ কিলোমিটার দূরবর্তী রঘুনাথগঞ্জে গঙ্গায় অবগাহন স্নান সেরে ঘটে জল ভরে ঢাক, কাঁসরঘন্টা, শঙ্খ বাজিয়ে গ্রাম পরিক্রমা করে এসে মন্দিরে স্থাপিত সমস্ত দেবদেবীর মস্তকে শিবজ্ঞানে জল ঢালেন। তান্ত্রিক মতে অভিষেক সম্পূর্ণ হয় এবং সান্ধ্যকালীন সময়ে প্রায় চার হাজার ভক্ত মানুষের মধ্যে সব্জি, উপাদেয় খিচুড়ি ও পায়েসান্ন সারিবদ্ধভাবে বসিয়ে ভোগ পরিবেশন করা হয়।
প্রাচীনকাল থেকেই এই বুড়ো শিব মন্দিরকে কেন্দ্র করে পাইকরে ঐতিহ্যপূর্ণ বাৎসরিক উৎসব ভক্তমরা গ্রাম্য সমস্ত দেবদেবীকে নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় সে উৎসবের চার প্রহর এই বুড়ো শিব মন্দিরে হয়ে থাকে এবং পাগলা নদী গর্ভথেকে গদাধর শিব উত্তোলনের পর ষষ্ঠীর ব্রতকথা শ্রবণ করে এখানের অনুষ্ঠান শেষ হয়। এরপর মা ক্ষ্যাপা কালীর অনুষ্ঠান বিশেষ ভাবে খড়্গের উপর দিবাসিন ভক্ত দন্ডায়মান হয়ে অন্য ভক্তরা কাঁধে তুলে নিয়ে পরিক্রমা করে ক্ষ্যাপা কালী মন্দির পেরিয়ে জয়দুর্গা তলার কাছাকাছি নামিয়ে পুনরায় স্নান সেরে কালী তলায় এসে কালীর প্রহর শেষ করে অগ্নি আহুতির পর অনুষ্ঠানের শেষ হয়। এই উপলক্ষে একদিনের একটি বড়ো ধরনের মেলাও হয়ে থাকে। বুড়ো শিব আর ক্ষ্যাপা কালীর মাহাত্ম্য কথা জগৎজুরে। এই মন্দির গাত্রে পূর্ব প্রতিষ্ঠা তারিখ সহ শেষ সংস্করণ উল্লেখ পূর্বক একটি স্মারক ফলক বসানো জরুরি।